ব্যাংক খাতে তারল্যের চাপ বেড়ে গেছে। এই চাপের কারণে ব্যাংকগুলোতে জমা অতিরিক্ত টাকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তারল্য কমায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ খাতে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে একদিকে বেসরকারি খাতের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে কমে গেছে নতুন কর্মসংস্থানের গতি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। সেখানে আরও দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। নভেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা ১০ দশমিক ২ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এ নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ ওই হারে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এ খাতে ঋণের প্রবাহ ডিসেম্বরে আরও ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ বাড়াতে হবে। এক মাসে ঋণ প্রবাহ এত বেশি মাত্রায় বাড়ানোর মতো সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর যেমন নেই, তেমনি বেসরকারি খাতেও তেমন চাহিদা বাড়েনি। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ৪ দশমিক ১১ শতাংশ এবং জুলাই-ডিসেম্বরে বেড়েছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম ছিল। এবারও এ খাতে ঋণ প্রবাহ প্রবৃদ্ধির হার এর কাছাকাছি থাকতে পারে। সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকাই প্রধান। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৮০ শতাংশই যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে যাচ্ছে মাত্র ২০ শতাংশ। প্রতিবছরে মোট কর্মসংস্থানের ৯৪ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে হচ্ছে মাত্র ৬ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনের বড় অংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগই বেসরকারি খাতের মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে অর্থনীতির সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যায়, উৎপাদনে ভাটা পড়ে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হারে লাগাম পড়ে। যা মানুষের আয় বাড়ার হার কমিয়ে দেয়। এতে জীবনযাত্রার মান কমে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমার কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমার জন্য ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহ কমে যাওয়াকে অন্যতম একটি কারণ হিসাবে উলেখ করা হয়েছে। এছাড়াও আমদানি ব্যয় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে ডলার কেনা বাবদ ব্যাংকের অর্থ চলে যাওয়া ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক মন্দার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ডলার সংকট ও ডলারের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে। এসব কারণে বেসরকারি খাতেরও ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা কমেছে। এসব মিলে এ খাতে ঋণ প্রবাহ কমেছে। গত কয়েক বছর ধরেই এ খাতে ঋণ প্রবাহ কমছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি উৎপাদন যেমন কমছে, তেমনি হ্রাস পাচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের গতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে টাকার হিসাবে ঋণ প্রবাহ সামান্য বাড়লেও ডলারের হিসাবে ঋণ প্রবাহ তো বাড়েইনি, উলটো আরও কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণের বড় অংশই আমদানিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে বেশি দাম দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে বেশি টাকা দিয়েও কম ডলার পাওয়া যাচ্ছে। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে দেশে ডলার সংকটের শুরু। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। আলোচ্য সময়ে দাম বেড়েছে ২৫ টাকা বা ৩০ শতাংশ। এদিকে বাজারে বর্তমানে সর্বোচ্চ ১২৬ টাকা দরেও ডলার বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে ডলারের দাম বেড়েছে ৪১ টাকা বা ৪৮ শতাংশ। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের এটিই অন্যতম কারণ। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে এখন প্রধান সংকট হচ্ছে ডলার। ডলারের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ডলারের জোগান বাড়ানো হলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। ডলার সংকট কমাতে বিনিময় হার আরও শিথিল করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অর্থনীতির স্বার্থে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। মন্দায় এ খাতের বেশি ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করার পদক্ষেপ থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি খাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। নভেম্বর পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ গ্রহণ বাড়েনি, বরং কমেছে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ হার বেড়ে ১৮ শতাংশ হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তবে সরকারের ঋণ এক দিনের নোটিশেও বাড়ানো সম্ভব বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়। কারণ যে কোনো দায়দেনা পরিশোধ বা সমন্বয় করলেই সরকারের ঋণ বেড়ে যায়। গত অর্থবছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ব্যাপক হারে ঋণ গ্রহণ করেছিল। যে কারণে মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক হারে চাপ পড়ে। এতে সরকার কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। এ কারণে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এর পরিবর্তে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়। এ ঋণ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ শোধ করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও ঋণ কম নিয়েছে। ফলে সরকারের বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থের প্রবাহ কমেছে। এতেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই ঋণের প্রবাহ কমার কারণে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবাহও কমে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে তারল্য ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ব্যাংকিং খাত কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে। বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির ফলে ব্যাংকিং খাতের তারল্যে একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। এ কারণে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। গত অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। এসব অর্থ বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার বাজারে জোগান দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারল্য সংকট মোকাবিলা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের সময় ব্যাংকে তারল্যের প্রবাহ বেড়েছিল। ওই সংক্রমণ কমার পর ২০২১ সালের জুলাই থেকে তারল্য কমতে থাকে। ওই বছরের জুনে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায়। ওই দুই বছর ৫ মাসে তারল্য কমেছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত এক বছর ৫ মাসে তারল্য কমেছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে ব্যাংকে তারল্য ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৫ মাসে কমেছে ১১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে তারল্য কমার কারণে ব্যাংকগুলোর ধারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে কলমানির সুদের হারও বেড়েছে। বৃহস্পতিবার কলমানির সুদের হার সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়ে ১০ শতাংশে ওঠেছে। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করতে নীতি সুদের হারও বাড়িয়ে সাড়ে ৪ থেকে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে বাজারে সব ধরনের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। এতে ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও বাড়ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে আগামীতে তারল্য সংকট কিছুটা কমে আসবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এছাড়া তারল্য কমার আরও কারণ হচ্ছে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়া ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া। এসব সমস্যা সমাধানে চলতি বছরেও নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।