মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মূল খাবারের উপাদান চালের দাম নিয়ে কারসাজির শেষ নেই। প্রান্তিক পর্যায়ে উৎপাদনকারী কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেলেও মিল মালিক, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা মিলে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ভোক্তারা। বছরের পর বছর ধরে অস্বাভাবিক চড়া মূল্যে চাল কিনতে হচ্ছে তাদের। এমন কোনো বছর, এমন কোনো মাস নেই চালের দাম বৃদ্ধি ছাড়া কমেছে। ধারণা করা হচ্ছিল, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অন্তত চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে এনে দেশের মানুষকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করা হবে। কিন্তু ঘটেছে উলটো। নির্বাচনের পরদিন থেকেই হঠাৎ সব ধরনের চালের দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ২ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। মনপ্রতি বাড়ে ৮০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা। চালের বাজারে এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ে দেশে একরকম হইচই পড়ে যায়। টনক নড়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন খাদ্যমন্ত্রী। ওই বৈঠকে চালকল মালিকরা এক ধরনের ধোকা দেন। তারা জানান, নির্বাচনের কাজে জড়িয়ে পড়ায় তারা ধান কম কিনেছেন। ধান কম কেনায় চালের কম উৎপাদনও হয়েছে। এতে করে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তারা আরও বেশি করে চাল উৎপাদনসহ দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মন্ত্রীর অনুরোধের পরও চালের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। দাম বেড়েছে ৬ টাকা। কমেছে মাত্র ১ টাকা। মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩ টাকা এবং কমেছে ১ টাকা। কিন্তু কাজ হয়নি। ফলে চাল কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়েই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। শনিবার রাজধানীর বাড্ডায় অভিযান চালায় খাদ্য অধিদপ্তর। অভিযানের আগাম খবরে অনেক চাল ব্যবসায়ী দোকানবন্ধ করে পালিয়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বারবার সতর্কতামূলক প্রচারণা চালানো হয়। বাড়তি দাম নিয়ে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা সে কথা না শুনে সব ধরনের চাল কেজি প্রতি ২-৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি করে যাচ্ছে। শনিবারের অভিযানে অনেক ব্যবসায়ী দোকানের শাটার বন্ধ করে পালিয়ে গেলেও কয়েকজনকে সতর্ক করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারক টিম। তারা জানায়, এখন থেকে আর ডাকঢোল পিটিয়ে কোনো অভিযান করা হবে না। হঠাৎ অভিযানে বাস্তব চিত্র দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা। যদিও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারক টিমকে এখনো অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা বা শাস্তির আওতায় আনার কোনো অনুমতি দেয়নি খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে অভিযান পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তারা কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন। একাধিক কর্মকর্তা জানান, কর্তৃপক্ষ অভিযান জরিমানা করার অনুমতি দেয়নি। আগামী দিনে কি নির্দেশনা দেন তা দেখার অপেক্ষায় আছি। এদিকে, বাড্ডা এলকায় অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া উপ-সচিব ড. জয়নাল আবেদিন শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অভিযান চলছে। অভিযানের ধারা অব্যাহত থাকলে চালের দাম কমতে বাধ্য। তিনি বলেন, কাউকে না জানিয়ে আগামী দিনের অভিযান করা হবে। গত বৃহস্পতিবার থেকে খাদ্য অধিদপ্তরের ওই টিম রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ বাজার, খিলগাঁও তালতলা বাজার, ঠাটারি বাজার, কাওরান বাজার, মহাখালী বাজার, বাড্ডা বাজার এবং মিরপুর শাহআলী বাজারে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান পরিচালনাকারী একাধিক কর্মকর্তা জানান, আড়তদাররা তাদের বলেছেন সব খরচসহ তারা কেজিপ্রতি দুই টাকা লাভ করেন। কিন্তু মিলগেট থেকে কেনার কাগজপত্র দেখতে চাইলে তাদের অনেকেই তদারক টিমকে সঠিক কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। বরং সব সময় বেশি দামে কেনার কাগজপত্র প্রদর্শন করেন। অনেকে আবার মিল গেট থেকে কেনা চালের কাগজপত্র হারিয়ে যাওয়ার অজুহাত দেখান। এদিকে খুচরা বাজারে চাল বিক্রির ক্ষেত্রেও চরম ঠকবাজি চলছে। কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত লাভ করেন ব্যবসায়ীরা। তদারক টিমকে তারাও চাল কেনার রশিদ দেখাতে পারছেন না। অভিযানে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীদের শতকরা ৭০ জনের ফুড গ্রেইন লাইসেন্স নেই। থাকলেও নবায়ন করা নেই। গত বৃহস্পতিবার যাত্রাবাড়ীতে জনপ্রিয় রাইস এজেন্সিতে গিয়ে তদারক কর্মকর্তা ও তার টিম দেখতে পান আটাশ-১ জাতের চাল প্রতি কেজি ৫১ টাকা ক্রয় করে ৫৪ টাকা বিক্রি করছেন। তাৎক্ষণিক ওই প্রতিষ্ঠানের মূল্য তালিকা সংশোধন করে ৫৩ টাকা করেন। তদারকি দল দিদার রাইস এজেন্সিতে গিয়ে দেখেন এরফান অটো রাইস মিলের মিনিকেট চাল ৬৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে এই প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছে চাল কেনার চালান দেখতে চান কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার রবিউল হোসেন চালান বের করে দেখান। এতে দেখা যায়, ১৫ জানুয়ারি ৬৫ টাকা কেজি দরে চাল কেনা হয়েছে। ম্যানেজার জানান, সেদিন ২৮০ বস্তা চাল কিনতে ২২ হাজার ৫০০ টাকা ট্রাক ভাড়া এবং শ্রমিকদের দেওয়া হয় ৩ হাজার ৮০ টাকা মজুরি। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনতে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালে খরচ পড়েছে ৯১ টাকা ৩৫ পয়সা। এ পর্যায়ে তদারক কর্মকর্তারা আগের চালান দেখতে চান। কিন্তু ম্যানেজার তা দেখাতে গড়িমসি করেন। কর্মকর্তারা তাকে সতর্ক করে বলেন, ১৫ জানুয়ারির আগের চালানের চাল যদি গুদামে পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর ম্যানেজার ড্রয়ার থেকে চালান বের করেন। এতে দেখা যায়, চাল কেনা হয়েছে ৬১ টাকা কেজি দরে। শুনে তদারক কর্মকর্তারা ম্যানেজারকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে মিনিকেট চালের দাম ৬৯ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ টাকা করতে বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তালিকাও সংশোধন করার নির্দেশ দেন। তাদের উপস্থিতিতে সেটি করেন দিদার রাইস এজেন্সির লোকজন।