এখনো বন্ধ তিন সার কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র

প্রকাশিতঃ জানুয়ারী ২১, ২০২৪ | ৮:৫৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

আকস্মিক গ্যাস সংকটে বড় ধরনের ধাক্কা খেল চট্টগ্রামের গ্যাসনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ৩৬ ঘণ্টা পর শনিবার বিকাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এখনো গ্যাসের চাপ কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ রোববারের মধ্যে পুরোপুরি চলে এলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পুরো চাপ আসতে একটু সময় লাগবে। বিশেষ করে সার কারখানায় পুরো চাপ আসতে প্রায় এক সপ্তাহ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২/১ দিন লাগবে। এ কারণে গ্যাস সংকটে দুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) সার কারখানা। অপরদিকে গ্যাসচালিত শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনও দুদিন ধরে বন্ধ। সিইউএফএল-এর মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রদীপ কুমার নাথ শনিবার বলেন, ‘গ্যাস না পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ মেট্রিক টন সার উৎপাদন হচ্ছিল।’ তিনি জানান, গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস আসতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। গ্যাসের পুরো চাপ এখনো আসেনি। এছাড়া সিইউএফএল একবার বন্ধ হলে এর কারিগরি সিস্টেমের কারণে আবার চালু করে উৎপাদনে যেতে ৫-৭ দিন সময় লেগে যায়। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান জানান, চট্টগ্রামের সার কারখানাগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে টেকনিক্যাল ত্রুটি দেখা দিলে এগুলোয় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর শনিবার বিকাল থেকে স্বাভাবিক হলেও এখনো গ্যাসের চাপ একদম কম। বাসাবাড়িতে ঠিকমতো জ্বলছে না গ্যাসের চুলা। তাই বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে রাইস কুকার ব্যবহার করতে হচ্ছে। কেউ আবার খাবার কিনতে ছুটছেন হোটেল-রেস্তোরাঁয়। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। বাচ্চাদের খাবার বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু সবাই তো এভাবে খাবার কিনতে পারছেন না। সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকদেরও ঘুম নেই, খাওয়া নেই। গ্যাসের জন্য অনেকে দুদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ বলেন, গ্যাসের এমন সংকট জীবনে কখনো দেখেননি। মোদ্দা কথা, গ্যাসের অভাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সবকিছু একরকম অচল হয়ে পড়ে। সূত্র জানায়, পাইপলাইনে শুক্রবার রাত থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও শনিবার বিকাল পর্যন্ত পর্যাপ্ত গ্যাস পায়নি সিইউএফএল। ফলে এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। এ কারখানায় প্রতিদিন ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হয়। গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ আসার পর কারখানাটি চালু করতে হবে। চালু করতেই প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। ফলে কারখানাটি উৎপাদনে ফিরতে আরও অন্তত এক সপ্তাহ লাগতে পারে। একইভাবে গ্যাস না থাকায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রামের আরও দুটি সার কারখানা কাফকো এবং ডিএপি সার কারখানা। তিনটি সার কারখানা একযোগে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বোরো মৌসুমের শুরুতেই ব্যাহত হচ্ছে সার উৎপাদন। এদিকে গ্যাস সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রও। গ্যাসচালিত শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন দুদিন ধরে বন্ধ। তবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলেও চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে ছিল। গ্যাস সংকটের কারণে এটার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। তাই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহে তেমন সমস্যা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকে জানান, শুধু সার ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, গ্যাস সংকটে ইস্পাত কারখানা, পোশাক কারখানার আয়রন ও ডাইং ইউনিটসহ গ্যাসচালিত ছোট-বড় অনেক কারখানায়ই উৎপাদনে ধস নামে। এ সংকট থেকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের (কেএসআরএম) একজন কর্মকর্তা জানান, গ্যাসের অভাবে কারখানার নিজস্ব পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া মেল্টিং ইউনিটের (লোহা গলানো) উৎপাদনও ব্যাহত হয়। সব মিলিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কমে গেছে। চট্টগ্রামে বেশ কটি বড় আকারের স্টিল রি-রোলিং মিল রয়েছে। এগুলো থেকে দেশের রডের চাহিদার বড় একটি অংশ মেটানো হয়। চট্টগ্রামে গ্যাসনির্ভর শিল্পকারখানার সংখ্যা কত, এর সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি এমএ মাহবুব চৌধুরী বলেন, প্রায় সব কলকারখানাই কোনো না কোনোভাবে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে ইস্পাতশিল্পে যেখানে লোহা গলাতে হয়, সেই ধরনের শিল্পে গ্যাস অপরিহার্য। এছাড়া বয়লার আছে-এমন কারখানাগুলোও গ্যাসে চলে। তৈরি পোশাকশিল্পের আয়রন ও ডাইং ইউনিটও চলে গ্যাসে। কেউ অনেক পোশাক উৎপাদন করল, কিন্তু আয়রন প্ল্যান্ট বন্ধ থাকলে পোশাকের ফিনিশিং দেওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে সময়মতো পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, গত দুই দিনে অনেক তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক পণ্য শিপমেন্ট করতে পারেনি। এর ফলে বিদেশি ক্রেতারা সময়মতো পণ্য পাবে না। এতে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গ্যাস সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে জানান এই ব্যবসায়ী নেতা। কেজিডিসিএল সূত্র জানায়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি (তরলীকৃত গ্যাস) টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। যার পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দুটি টার্মিনালের একটি আগে থেকেই বন্ধ ছিল। অপর টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত শেষে শুক্রবার রাত থেকে এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। তবে পাইপলাইনে গ্যাস আসতে কিছুটা সময় লাগে। শনিবার বিকালের দিকে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। শিল্পকারখানাগুলোয়ও গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। সার কারাখানাসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে চাপ বাড়ানো যাবে না বলে এসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে ফিরতে একটু সময় লাগবে।