বাস্তবায়ন হয়নি আগের আট নির্দেশনা

প্রকাশিতঃ ফেব্রুয়ারী ৭, ২০২৪ | ৮:৫১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

প্রধানমন্ত্রীর দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ ১২ দফা নির্দেশনার আটটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র চারটি। ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে নয় বছর পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার একই মন্ত্রণালয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। এবারও তার নির্দেশনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী চাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের ওপর শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। সমন্বিতভাবে কাজ করতে বলেছেন বাণিজ্য, কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে। পাশাপাশি সব সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের আগেই প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পর আর আমাদের কেউ নেই। এখন আমরা আশা করব একটি যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক আরোপ করার। আগের নির্দেশনাগুলো কেন বাস্তবায়ন হয়নি সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনাবলির বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে দেখা গেছে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে ১২টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনটি নির্দেশনা ছিল দ্রব্যমূল্যকে ঘিরে। দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে নির্দেশনায় বলা হয়, মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজারে সরকারে অবস্থান সৃষ্টি করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর মজুত, সরবরাহ স্থিতিশীল ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, বাজার মনিটরিং, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কার্যক্রম দেশব্যাপী বৃদ্ধি, ভেজাল বিরোধী অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। এছাড়া রোজার প্রসঙ্গে নির্দেশনায় বলা হয়, রমজান মৌসুমে তেল, ডাল ও ছোলা জাতীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে রোজার আগেই এসব পণ্যের মজুত গড়ে তুলতে হবে এবং মজুত পণ্য সংরক্ষণের জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সরকারি গুদাম ভাড়া দিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনে এ দুটি নির্দেশনা প্রসঙ্গে বলা হয়, কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কিছু বিষয়ে বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান আছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবসায়ী নেতারা ও সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে চাহিদা নিরূপণ ও মজুত পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রায় ৭০০ বাজার মনিটরিং করা হয়েছে। এছাড়া নির্দেশনায়-টিসিবির সক্ষমতা বাড়াতে গুদাম ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, আধুনিক মানসম্মত গুদাম নির্মাণ, উৎপাদনের মৌসুমে বিদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং যথাসময়ে বাজারজাত করে পণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজারের ভারসাম্য রক্ষায় প্রভাবক হিসাবে কাজ করতে বলা হয়। তবে এই কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্প আয়ের এক কোটি পরিবারকে কম মূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে লিফলেট বিতরণসহ আরও কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এদিকে পণ্য রপ্তানি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল-রপ্তানি বৃদ্ধিতে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, মাননিয়ন্ত্রণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টিতে বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, জেলাভিত্তিক অপ্রচলিত পণ্যের গবেষণাসহ উৎপাদন বৃদ্ধি, মনোনয়ন সংরক্ষণ, বিপণন এবং রপ্তানি বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা প্রদানের করণীয় নির্ধারণ করতে বলা হয়। কিন্তু এই নির্দেশনার এখনো কিছু বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান আছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসব নির্দেশনা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন অনেক কাজ বাস্তবায়নাধীন আছে। নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার উদাহরণ হচ্ছে রপ্তানি আয় এখনো তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। গুটিকয়েক পণ্যের ওপর আটকে আছে রপ্তানি পণ্যের বাজার। ফলে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং পাটপণ্যের নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীতে রপ্তানির বাজারে তৈরি পোশাক থেকে বেরিয়ে আসার কথাও তিনি বলেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আরও বলা হয়, কৃষিজাত পণ্যের নতুন নতুন আইটেম তৈরি করে তা পরিবেশবান্ধব প্যাকেটজাত করে বিদেশে রপ্তানি, বিদেশে অবস্থানরত দেশের মিশনগুলোকে বাণিজ্যিক মিশনে পরিণত করে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি এবং ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং পর্যটন বাণিজ্য গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া। এছাড়া বাণিজ্যিক উইং নেই এমন মিশনগুলোতে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। জানা গেছে, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ-পরবর্তী বহির্বিশ্বে রপ্তানির ক্ষেত্রে ডিউটি ও কোটা ফ্রি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রপ্তানি খাতে ভর্তুকি তুলে দিতে হবে। এতে রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে অনেক সক্ষমতা হারাবে। সার্বিকভাবে রপ্তানি বাজারে একটি বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) অথবা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সম্পাদন করতে সুপারিশ করেছে এলডিসি উত্তরণ চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় গঠিত ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ’ বিষয়ক সাবকমিটিও। এ কমিটি আরও বলেছে, বিকল্প উপায়ে রপ্তানিকে উৎসাহিত করার পন্থা উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএ করার প্রতি জোর দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওই অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, রপ্তানি আয় বাড়াতে প্রাথমিকভাবে ১০টি দেশ ও ৩টি জোটের সঙ্গে এফটিএ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে-ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, মালয়েশিয়। আর জোটের মধ্যে রয়েছে আসিয়ান অর্থনৈতিক জোট, মার্কোসপুর জোট ও ইউরোপিয়ান অর্থনৈতিক জোট। এছাড়া তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মরক্কো, মরিশাস, সেনেগাল, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, কেনিয়ার সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএ করার ব্যাপারে নেগোসিয়েশন চলছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মতে, উল্লেখিত চুক্তিগুলো সম্পন্ন হলে দেশের রপ্তানি আয় আরও বাড়বে। এতে এলডিসি থেকে উত্তরণে রপ্তানি খাতে যে সংকটের শঙ্কা রয়েছে সেটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভৌগোলিক দিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাদের মতে, আঞ্চলিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। এজন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক নীতিমালার সংস্কার ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন, পণ্য বহুমুখীকরণ, কর ও শুল্ক কাঠামোর আধুনিকায়ন, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, ক্রস বর্ডার বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে আরও জোরদার করার বিষয়টি। এ বিষয়ে সেখানে বলা হয়, ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আইন (সংশোধন) পাশ হয়েছে। বর্তমান এ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান অর্গানোগ্রামকে যুগোপযোগীকরণ করে নতুন অর্গানোগ্রাম প্রণয়নের কাজ চলছে।