রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ৪১ এ নম্বর ভবনের পাশেই প্রায় ১ বিঘা জায়গা দখলে নিয়ে চলছে দোকান তৈরির কাজ। বাঁশের চালার ওপর ত্রিপল ও তাঁবু টানিয়ে অন্তত ৫০টি দোকান নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর ৪৩ এ নম্বর ভবনের পাশে আরও ২২টি দোকান তৈরি করে এরই মধ্যে দোকানদারদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি দোকান বরাদ্দ বাবদ ৫৫ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে দখলবাজ চক্র। আর কলোনিসংলগ্ন খিলগাঁও রেলগেটের পাশ দিয়ে দুই বিঘারও বেশি জায়গা দখলে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে টিনশেড পাকা মার্কেট। এই মার্কেটে দোকান রয়েছে ১৬৪টি। সম্প্রতি রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ম্যানেজের কথা বলে এসব দোকান মালিকদের কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, কলোনি ও খিলগাঁও রেলগেট কাঁচাবাজারের পাশে রেলওয়ের অন্তত ১২০ কোটি টাকার তিন বিঘা জায়গা দখলে নিয়ে এই দোকান বাণিজ্যের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন খিলগাঁও বাজার মালিক সমিতির নেতা হিসাবে পরিচিত দুই সহোদর মোকসেদ আলী সরদার ও আলী আজগর। তাদের মদদ দিচ্ছে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক। চাঁদা আদায় ও দখল বাণিজ্যের বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এই অভিযোগের সূত্র ধরে সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে দখল বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র। রাজধানীতে প্রকাশ্যে রেলের মূল্যবান জায়গা দখল প্রসঙ্গে রেল মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। রেলের জায়গা দখল করে ব্যবসায়ীদের দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে দখলদারদের অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে।’ জানা গেছে, খিলগাঁও কাঁচাবাজারে পাকা ভবন তৈরি করতে সম্প্রতি বাজারের টিনশেড সব দোকান ভেঙে ফেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এরপরই শাহজাহানপুর কলোনি ও পাশের রেলওয়ের জায়গা দখলে নিয়ে দোকান বাণিজ্যের মহোৎসবে মেতে ওঠে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র। অভিযোগ আছে, প্রকাশ্যে এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খিলগাঁও বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোকসেদ আলী ও তার ভাই সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আজগর। পেছন থেকে এদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি কামরুজ্জামান বাবুল। আর পুরো চক্রের মদদদাতা হিসাবে রয়েছেন বিদেশে পলাতক পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী খিলগাঁও-শাহজাহানপুর এলাকার এক সময়ের ত্রাস জাফর আহমেদ মানিক। স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০ জানুয়ারি খিলগাঁও বাজার মালিক সমিতির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও দুই সহোদর প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচন আটকে রাখেন। যারা তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করছেন তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রাণ ভয়ে এখন তারা মার্কেটেই যেতে পারেন না। আর এর অন্যতম কারণ দখল বাণিজ্য দুই সহোদরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাখা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক সময় শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিকের হয়ে ফুটপাতের চাঁদা তুলতেন মোকসেদ আলী। ২০১৫ সালে চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মতিঝিল কলোনি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তখন পুলিশের গুলিতে মোকসেদ আহত হয়েছিলেন। মোকসেদ আলী সরদার বলেন, ‘রেলগেট কাঁচাবাজার মার্কেট বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য দোকান ভেঙে ফেলা হয়েছে। এরপর আমরা নির্বাচিত বাজার কমিটির পক্ষ থেকে মেয়রের কাছে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের দাবি জানাই। তখন তিনি পাশে কোনো ফাঁকা জায়গা থাকলে সেখানে দোকান বসাতে বলেন। রেল মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আমরা সেখানে কিছু দোকান তৈরি করেছি। আরও কিছু দোকান তৈরি করা হচ্ছে। এসব দোকান ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হবে। এজন্য দোকানপ্রতি ৫০-৬০ হাজার করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ ঠিক না। শুধু দোকান তুলতে যে খরচ হচ্ছে সেটা নেওয়া হচ্ছে। রেলের জায়গায় আগের তোলা ১৬৪ দোকান ভেঙে দেওয়ার কথা বলে ৬০ লাখ টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগও ঠিক নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মানিক নামের কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসীকে চিনি না। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও নেই। আমার ভাইয়ের বয়স ৩০ বছর। মানিক ২০২০ সাল থেকে পলাতক। তাহলে তার সঙ্গে আমার ভাইয়ের সম্পর্ক থাকে কিভাবে?’ চাঁদা তুলতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার কথাও তিনি অস্বীকার করেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহজাহানপুর কলোনির ৪৩ এ ভবনের পাশে রেলওয়ের জায়গা দখল করে ২২টি দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে দখলদাররা। এই ২২ দোকান বরাদ্দ বাবদ তারা চাঁদা তুলেছে ১৪ লাখ টাকা। এসব দোকানে সংযোগ দেওয়া হয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন। এই বিদ্যুৎ লাইন ব্যবহার করে একটি বাল্ব জ্বালাতে দোকানদারদের প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকা করে। রেলের জায়গায় গড়ে তোলা দোকানগুলোতে অন্তত ৩০০ বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে। এ খাত থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয় ১৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে মাসে চাঁদা তোলা হচ্ছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির শাপলা জামে মসজিদ গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, ৪২ নম্বর ভবনের সামনের রাস্তার দুপাশ দখল করে বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকান। রাস্তা ধরে একটু এগোতেই ৪১ এ নম্বর ভবনের পাশেই বিশাল কর্মযজ্ঞে চোখ আটকে যায় এ প্রতিবেদকের। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছিল অনুষ্ঠান আয়োজন করতে ত্রিপল টাঙিয়ে প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলছে। কিন্তু আলাপকালে স্থানীয় এক যুবক এ জানান, কয়েকদিন আগে স্থানীয় প্রভাবশালী দখলবাজ চক্রের সদস্যরা রেলওয়ের প্রায় এক বিঘা জায়গা দখলে নিয়ে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে। এরপর সেখানে উপরে বাঁশ ও ত্রিপলের চালা দিয়ে শুরু করে নির্মাণ কাজ। এখানে দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি দোকান বরাদ্দ বাবদ ৫৫ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। কলোনির ভেতরের রাস্তা ও আশপাশের রেলওয়ের জায়গা দখলে নিয়ে দোকান বসানোর কারণে কলোনির আবাসিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন বাসিন্দারা। কলোনির বাসিন্দারা রেলপথমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। আবেদনে দ্রুত এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করে কলোনিবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। আবেদনে বলা হয়েছে, মোকসেদ সরদার ও আলী আজগরের নেতৃত্বে একটি চক্র কলোনির বাসা-বাড়ির সামনে অবৈধ দোকানপাট বসিয়ে নানা সংকট তৈরি করছেন। দিন-রাত সমান তালে কলোনিতে বাজারের লোকজনের সমাগম হওয়ায় কলোনির আবাসিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় তারা বাসার দরজা-জানালাও খোলা রাখতে পারছেন না। দ্রুত এ পরিস্থিতির অবসান চান তারা। দোকানদাররা জানান, খিলগাঁও রেলগেটের দক্ষিণ পাশে রেললাইনের পাশের প্রায় দুই বিঘা জায়গা দখল করে দীর্ঘদিন আগে গড়ে তোলা হয়েছে টিনশেড পাকা মার্কেট। এই মার্কেটে দোকান রয়েছে ১৬৪টি। সম্প্রতি এসব দোকান থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও হুমকি-ধমকির ঘটনা থেকে পরিত্রাণ চেয়ে রেলপথমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন মোহাম্মদ মনু মাঝি নামের এক ব্যবসায়ী। আবেদনে তিনি বলেন, ‘রেলওয়ে মার্কেট ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দোকানপ্রতি ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা তুলেছে। চাঁদা না দিলে দোকান তালা মেরে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে আমি ৫০ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হই। চাঁদা তোলার কারণ জানতে চাইলে মোকসেদ ও আজগর জানান, এই টাকা তুলে রেলের কর্মকর্তাদের দেবেন। যাতে তারা এই মার্কেট উচ্ছেদ না করেন। ইতোমধ্যেই তারা দোকানদারদের কাছ থেকে অন্তত ৬০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন। এখন আরও টাকার দাবিতে তারা হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।’ জানা গেছে, রেলওয়ের জায়গা দখলে নিয়ে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষও তৈরি করেছেন দুই সহোদর। এই অফিসে দোকানদারদের ডেকে নিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়। অফিসটি টর্চার সেল হিসাবেও ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।