কক্সবাজারের পেকুয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পূর্বিতা চাকমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) করা অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত পূর্বিতা চাকমা বর্তমানে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কর্মরত আছেন। অভিযোগ তদন্ত করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) তাপ্তি চাকমাকে। গত ২৫ জানুয়ারি প্রথম দফায় অভিযোগের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগে দেখা গেছে, পূর্বিতা চাকমা দুবছরের বেশি সময় পেকুয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময়ে পেকুয়া উপজেলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের মাঠ বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মাসিক ৩ লাখ টাকায় ভাড়া দিয়ে ২ বছরে ৭২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাত করেছেন। মুজিববর্ষের ঘর প্রকৃত গৃহহীনদের না দিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সমাজের বিত্তশালীদের দিয়েছেন। এতে মুজিববর্ষের ঘর পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত গৃহহীনরা। অভিযোগে আরও জানা যায়, এছাড়া পেকুয়া সদর ইউনিয়নের বন্যাকবলিত এলাকা মেহেরনামায় ৬০ হাজারের অধিক মানুষের বসবাস। ওই এলাকায় কোনো গরিব মানুষের জন্য মুজিববর্ষের ঘর বরাদ্দ দেননি তিনি। এ এলাকার অনেকেই মুজিববর্ষের ঘর পেতে আবেদন করেছিলেন। আবেদনকারীদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন ইউএনও কার্যালয়ের তৎকালীন প্রধান সহকারী মো. শরীফের মাধ্যমে। পরে তিনি আরও টাকা দাবি করলে দিতে না পারায় কারও কপালে জুটেনি মুজিববর্ষের ঘর। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, পূর্বিতা চাকমা ২০২১-২২ এবং ২০২৩ অর্থ বছরের থোক বরাদ্দের কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেননি। থোক বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। তথ্য অধিকার আইনে থোক বরাদ্দের প্রকল্প বাস্তবায়নের তালিকা চাইলে আবেদনকারীকে ডেকে মামলা-হামলার ভয় দেখাতেন তিনি। পেকুয়া সদর ইউনিয়নের আওতাধীন মেহেরনামাকে আলাদা ইউনিয়ন ঘোষণা করতে স্থানীয়দের নিয়ে গনশুনানি করেন তিনি। সেখানে সবাই আলাদা ইউনিয়ন হওয়ার পক্ষে সম্মতি দেন। যেহেতু বর্তমান সদর ইউনিয়ন আয়তনের দিক দিয়ে অনেক বড়। সেক্ষেত্রে সবার কাঙিক্ষত সেবা নিতে কষ্ট হয়। পরে পূর্বিতা চাকমা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ২৯ বর্গ কিলোমিটারের পেকুয়া সদর ইউনিয়নকে ২৬ বর্গ কিলোমিটার দেখিয়ে এবং ১৩ বর্গ কিলোমিটারের মেহেরনামাকে ১০ বর্গ কিলোমিটার উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এভাবে তিনি অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতা করে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। পেকুয়া সরকারি মডেল জিএমসি ইনস্টিটিউশনের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন ইউএনও পূর্বিতা চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক তহবিলের সাড়ে ৩১ লাখ টাকা গায়েবের অডিট প্রতিবেদন জমা নিয়ে রহস্যজনক কারণে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি তিনি। অডিটে দেখা যায়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) উলফাত জাহান চৌধুরীকে প্রধান করে বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকসহ তিন সদস্যের অডিট কমিটি গঠন করা হয় ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের যাবতীয় আয়-ব্যয় হিসাব করে ২০২২ সালের ২৮ মার্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ইউএনও পূর্বিতা চাকমার কাছে অডিটের প্রতিবেদন জমা দেন তারা। এছাড়া অডিট কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম দুর্নীতির কথা তুলে ধরা হয়। তিনি পূর্বের অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখিত তহবিলের সাড়ে ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে আরেকটি অডিট কমিটি গঠন করেন। তবে দ্বিতীয় বার গঠিত অডিট কমিটির প্রতিবেদনে কি অনিয়ম পাওয়া গেছে, তা রহস্যজনক কারণে গোপন রেখে চলে গেছেন তিনি। ভুক্তভোগী ছৈয়দ আলম নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি ২০২৩ ইংরেজির এপ্রিল মাসে সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূর্বিতা চাকমা মুজিববর্ষের আওতায় মগনামা ও বারবাকিয়া ইউনিয়নে ৩৬টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য মৌখিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হই। প্রতিটি ঘর ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তৈরি করে দেওয়ার জন্য ইউএনও পূর্বিতা চাকমা আমাকে দায়িত্ব দেন। ইউএনও’র নির্দেশ মোতাবেক আমি মগনামা ইউনিনের শরৎঘোনা গ্রামে ১০টি, মটকাভাঙ্গা গ্রামে ১৫টি, সোনালী বাজারে ১টি, বারবাকিয়া ইউনিয়নের মগপাড়া গ্রামে ৫টি ও বুধামাঝির ঘোনা গ্রামে ৫টিসহ সর্বমোট ৩৬টি ঘর তৈরির কাজ করেছি। গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত আমি শ্রমিক নিযুক্ত করে ৩৬টি মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ কাজ শেষ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, প্রতিটি ঘর আমাকে ২লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তৈরির করে দেওয়ার জন্য ইউএনও পূর্বিতার চাকমা নির্দেশ দেওয়ায় আমি উনার কথামতো কাজ করে দিয়েছি। সেই হিসেবে ৩৬টি ঘরের সর্বমোট বিল হয় ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু জুলাই মাস পর্যন্ত ইউএনও পূর্বিতা চাকমা আমাকে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে কয়েক কিস্তিতে ৭৪লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। আরও ১৬ লাখ টাকা ও ঘরের বেইজ ঢালাই বাবদ ৪ লাখসহ সর্বমোট ২০ লাখ টাকা ঘর নির্মাণ বাবদ আমি ইউএনও’র কাছ থেকে পাওনা রয়ে গেছি। অভিযোগকারী বলেন, ইউএনও পূর্বিতা চাকমা আমার পাওনা ২০লাখ টাকা পরিশোধ না করে পেকুয়া থেকে বদলি হয়ে চলে গেছে চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলায়। যাওয়ার আগে টাকা চাইলে তিনি আমাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দেন। ইউএনও পূর্বিতা চাকমার কাছ থেকে মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ বাবদ আমার পাওনা ২০লাখ টাকা উদ্ধারের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। অভিযোগকারী নাছির উদ্দিন বাদশা ও মেহেদী হাসান বলেন, পেকুয়ার সাবেক ইউএনও পূর্বিতা চাকমার অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে আমরা যৌথভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়রাম্যানের ও মন্ত্রী পরিষদের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলাম। গত ২৫ জানুয়ারি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) তাপ্তি চাকমা কার্যালয়ে শুনানি হয়েছে। শুনানিতে আমরা তদন্ত কর্মকর্তাকে পেকুয়ায় সরেজমিনে এসে তদন্ত করার আবেদন করেছি। আশা করি, তিনি সরেজমিনে এসে তদন্ত করবেন। ইউএনও পূর্বিতা চাকমা বলেন, অভিযোগ তদন্তাধীন বিষয়। এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করেন। তদন্ত কর্মকর্তা ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) তাপ্তি চাকমা বলেন, এটা তদন্তের বিষয় তদন্ত চলমান আছে। তিনি অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, এ বিষয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেন আপনার— জানতে চেয়ে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।