একজন মানুষ যখন কোনো আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন বা নেতৃত্ব দেন, তখন বুঝে নিতে হয়, আন্দোলননিহিত মর্মবাণী মানুষটির চেতনায় প্রগাঢ় ছায়া ফেলে আছে। ভেতরের তাগিদ না থাকলে মানুষ কোনো কর্মেই নিবেদিতপ্রাণ বা ঐকান্তিক হতে পারে না। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্তির দালিলিক প্রমাণ আছে Secret Documents এবং তার নিজস্ব জবানি অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বই দুটিতে। কিন্তু এ প্রমাণগুলো ঘটনা ও ঘটনাক্রম তুলে ধরে বটে; কিন্তু বলে না (বা বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেননি) কেন বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের প্রতি নৈকট্য অনুভব করেছিলেন। তবে সরাসরি না বললেও বঙ্গবন্ধু তার বাংলা ভাষাপ্রীতি ও ভাষা আন্দোলনের প্রতি নৈকট্যের কথা বলেছেন নানা ভাষণে। স্মরণে রাখা দরকার, এমন বক্তব্য শুধু ভাষা আন্দোলনের সময়ে উচ্চারিত হয়েছে তা নয়, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বহুবার তা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর গভীর দ্যোতনাসমৃদ্ধ এমন একটি উচ্চারণ ছিল ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারির ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার মাটি আমার স্থান।’ একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে মন্দ্রিত উচ্চারণে মানুষটির সামগ্রিক জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনের সারাৎসার উঠে এসেছে। এ মন্ত্রেই উজ্জীবিত ছিল ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালির রাষ্ট্রসাধনার দুর্মর আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী বাঙালির জেগে ওঠা এবং তার পরিণতি যে স্বাধীন বাংলাদেশ, তা বঙ্গবন্ধু মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি তার মতো তুলে ধরেছিলেন ১৯৭১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক বক্তৃতায়, ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতোধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না।’ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহ্বান ছিল ‘স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসাবে গড়ে তুলন’। ভাষার মর্যাদা যে স্বাজাত্যবোধের দ্যোতক, এমন একটি বার্তা পাওয়া গেল এ বক্তব্যে। অন্যদিকে শুরুতে ছিল ভাষার অন্তর্নিহিত রূপ সম্পর্কে চুম্বক বক্তব্য। এমন মন-মানসিকতার বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৪৭-এর ১৬ আগস্ট কলকাতার সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার সম্পাদকের কক্ষে এক আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কারণ তা পাকিস্তানের গরিষ্ঠ নাগরিকের ভাষা। দুদিন পর সিরাজউদ্দোলা হোস্টেলে আয়োজিত আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধু একই কথা বলেছিলেন। রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার প্রশ্নটি অর্থহীন মনে করলেও শিষ্য শেখ মুজিবের চাপে মত পালটিয়েছিলেন। ১৯৫৬-র ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইনসভায় বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’ ৭১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা একাডেমিতে বললেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সব সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে।’ তা-ই হয়েছিল। কিন্তু তবুও ’৭৫-এর ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসাবে এক আদেশে তিনি বললেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে-এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’ বর্তমানে বাংলা ভাষার পরিস্থিতি গুরুতর। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আরও কষ্ট পেতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেলেন। তিনি ইংরেজিতে বলার জন্য অনুরুদ্ধ হয়েছিলেন; রাজি হননি। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে রাষ্ট্রদূত ফারুক চৌধুরী তাৎক্ষণিক ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, যা হেডফোনে শোনা গিয়েছিল। ১৯৫২তে বঙ্গবন্ধু পিকিং এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনেও বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : চেয়ার প্রফেসর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস