কাগজ কলমের হিসাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার ৭২তম বছর পূর্ণ হলো আজ। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে যে ছাত্রসমাজ রাজপথে নেমেছিল সেই সময় তারা ছিলেন বয়সের তারুণ্যে। হিসাবে তখনকার ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের বয়স এখন নব্বই বছরের কাছাকাছি বা তারও বেশি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এই প্রজন্মটি প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী এখন পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার পথে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এমন ভাষাসংগ্রামীদের বেশিরভাগ ইতোমধ্যে মারা গেছেন। জীবিত আছেন মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন। যারা বেঁচে আছেন তাদের শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। পরিতাপের বিষয় ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্য ছাড়া তাদের খোঁজ আজ আর কেউ রাখেন না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এমন ভাষাসংগ্রামীদের অনেকেই গত কয়েক বছরে মারা গেছেন। জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ, হালিমা খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, আলী তাহের মজুমদার, ডা. সাঈদ হায়দার, আবু মিয়াসহ ভাষাসংগ্রামী হিসাবে পরিচিত অনেকেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। ভাষাসংগ্রামী হিসাবে সর্বজনবিদিত লেখক ও গবেষক আহমদ রফিক, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, শিক্ষাবিদ প্রতিভা মুৎসুদ্দি সবার বয়স নব্বইয়ের কোটায়। তবে তাদের কেউই শারীরিকভাবে খুব ভালো নেই। রোব ও সোমবার ভাষাসংগ্রামী ও লেখক আহমদ রফিকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারেননি। জানা গেছে এই ভাষাসংগ্রামী বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যাসহ দৃষ্টিশক্তি প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। জানা গেছে ভাষাসংগ্রামী এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বর্তমানে বাসায় থাকেন। এখন তার বয়স ৯২ বছর। বার্ধ্যক্যজনিত কারণে তিনি বাসা থেকে বের হন না। চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে মিরা সেন, জাহানারা রহমান, জওশন আরা রহমান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি নামগুলো জড়িয়ে আছে। আন্দোলন-সংগ্রামের শুরু থেকে পোস্টার লেখা, লাগানোসহ নানা কার্যক্রমে তারা অংশ নিয়েছিলেন। রাজপথে ছিলেন। ভাষাসংগ্রামী অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি দানবীর শহিদ রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বাংলাদেশ) লিমিটেডের শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। প্রতিভা মুৎসুদ্দির মুঠোফোনে মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে রিসিভ করেন তাকে দেখাশোনা করা একজন নার্স। পরে প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, আমি বেশ অসুস্থ। নার্স ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না। ভাষা সংগ্রামের প্রসঙ্গ টানতেই তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের গর্বের ইতিহাস। এ আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার আত্মসম্মান রক্ষার নয়, আরও অনেক কিছু। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালু করা এই আন্দোলনের অন্যতম বিষয় ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা এখনো চালু হয়নি। রাষ্ট্রীয় সব কাজ বাংলা ভাষায় ব্যবহার শতভাগ হয় না। তিনি বলেন, মিয়ানমার পেরেছে, নেপাল পেরেছে। অনেক রাষ্ট্র পেরেছে সর্বস্তরে তাদের মাতৃভাষাকে চালু ও প্রতিষ্ঠা করতে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলব, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু এবং প্রতিষ্ঠা করুন। ভাষা আন্দোলন গবেষক ও লেখক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ১৯৪৭, ১৯৪৮ এবং পরে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন, চিন্তাকে শানিত করেছেন তারা নিঃসন্দেহে অগ্রজ চিন্তার বাঙালি। সেই সময়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু এবং ইংরেজি প্রচলনের বিরুদ্ধে সমাজে যারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তারা বীর। প্রাকৃতিক নিয়মে তাদের অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো আর তাদের একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন কি আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস হারিয়ে যাবে না? না। ভাষাসংগ্রামীদের অনেকেই এই ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে লিখে গেছেন। কেউ কেউ ত্রুটিপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর তথ্যসমৃদ্ধ লেখাও লিখেছেন। নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব হবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে পূর্ণতা দেওয়া। তিনি বলেন, গবেষণা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ে সময়ে অনেক নতুন তথ্য সন্নিবেশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশেষ করে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সেই সময়ের কিছু কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হচ্ছে। নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় আরও হতে থাকবে।