অতিরিক্ত র্যাম্পের কারণে রাজধানীর কাওলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কার্যত ফ্লাইওভারে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এক্সপ্রেসওয়ে ওপর বা নিচ যে কোনোভাবেই হতে পারে। তবে এর মূল দর্শন হলো-বাধাহীন দ্রুতবেগে লম্বা দূরত্বে চলাচল। এক্সপ্রেসওয়ে কখনো দুটি শহরকে সংযুক্ত করে। আবার কখনো সংযোগ তৈরি করে আরেক এক্সপ্রেসওয়ে বা হাইওয়ের সঙ্গে। নগর সড়কের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ কোনো বিবেচনায় যৌক্তিক নয়। তারা জানান, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার। অন্যদিকে ঢাকার নগর সড়কের গতিবেগ ৫ কিলোমিটার, যা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির সড়ক। দ্রুতগতির গাড়িগুলো র্যাম্পে এসে আটকে যাবে। যার প্রভাব পড়বে ওপরের সড়কে। তখন এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগ কমে যাবে। ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ ১০টি র্যাম্প হতে পারত। কিন্তু তারা এক্সপ্রেসওয়ে দর্শন থেকে সরে গিয়ে টোল আদায়কে প্রাধান্য দেওয়ায় ৩১টি র্যাম্প করেছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। যেটা মূল সড়কের দৈর্ঘ্যরে চেয়েও বেশি। কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশের ওঠানামার পথে প্রায় তীব্র যানজট থাকছে। সবগুলো র্যাম্প চালু হলে নগরে নতুন নতুন আরও যানজট স্পট তৈরি হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা শহরের যানজটের ভোগান্তি কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় পর গত সেপ্টেম্বরে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা হয়ে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর দিয়ে যাত্রাবাড়ীর অদূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে হাইওয়েতে মিলবে এই সড়ক। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার কথা; যদিও এ সময়ের মধ্যে তা সম্ভব নয়। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদকাল আরও বাড়াতে হবে। তারা আরও জানান, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর চুক্তি সংশোধন হয়। এই প্রকল্পের ৩১টি র্যাম্পের দীর্ঘ ২৭ কিলোমিটার। মূল এক্সপ্রেসওয়ের ২০ কিলোমিটার ও র্যাম্পের দৈর্ঘ্য মিলিয়ে প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ হয়েছে প্রায় ১৯১ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি। পাশাপাশি সরকারও প্রকল্পের ২৭ শতাংশ বা ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৭০ শতাংশ। প্রকল্প চালু হওয়ার সময় থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বিবিএ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সব পরিবহণ চলাচল করতে পারে না। বর্তমানে চলাচল করছে কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস, হালকা ট্রাক, সব ধরনের বাস, মাঝারি ট্রাক ও ট্রাক। এসব যানবাহন চলাচলে পৃথক ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। টোলপ্লাজায় সেই পরিমাণ ভাড়া পরিশোধ করে চলাচলের সুযোগ মিলছে। বিশেষায়িত এই সড়কে তিন চাকার যানবাহন, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ও পথচারী চলাচলের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। জানা যায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ৩১টি র্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ওঠার র্যাম্প ১৫টি এবং নামার ১৬টি। চালু অংশে র্যাম্পের সংখ্যা ১৫টি। সেগুলো হলো বিমানবন্দরে ২টি, কুড়িলে ৩টি, বনানীতে ৪টি, মহাখালীতে ৩টি, বিজয় সরণিতে ২টি ও ফার্মগেটে ১টি। সরকারের এই অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। সম্প্রতি কয়েক কর্মদিবসে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়া র্যাম্পের পয়েন্ট সরেজমিন ঘুরে দেখা হয়। দেখা যায়, কর্মব্যস্ত দিনের সকাল, বিকাল ও সন্ধ্যায় তীব্র যানজট থাকে। র্যাম্প বা ওঠানামার পথে যানজটের কারণে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। কাওলা, ফার্মগেট, বনানী পয়েন্টে নিত্যদিনই র্যাম্পের পয়েন্টে তীব্র যানজট দেখা যায়। বৃহস্পতিবার বসুন্ধরার বাসিন্দা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী প্রকৌশলী মো. সাকেরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর খুব খুশি হয়েছিলাম। কারণ, দ্রুততম সময়ে বাসা থেকে সচিবালয় ও মতিঝিল এলাকায় যেতে পারব। নিয়মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করছি। কিন্তু সকাল, বিকাল ও সন্ধ্যার সময় ওঠানামার পথে তীব্র যানজট থাকে। এতে টোল দিয়ে চলাচলেও কাক্সিক্ষত সুবিধা মিলছে না। বনানীর বাসিন্দা মো. শরীফ উদ্দিনও তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে প্রায়ই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করেন। তিনি জানান, নিচের সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে গণপরিবহণকে ঢেলে সাজাতে হবে। নইলে এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা পাওয়া যাবে না। টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে চললেও প্রায়ই ওঠানামার পথে যানজটে দীর্ঘসময় নষ্ট হয়। এভাবে দ্রুতগতির সড়কের সুবিধা মিলবে না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত : এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দর্শন থাকে কোনো শহরকে বাইপাস করা বা দুটো বড় শহরের মধ্যে দূরত্ব কমানো। যাতে দ্রুত এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াত করা যায়। এটা নিচের সড়ক বা উড়াল পথে দুভাবেই করা যায়। তিনি বলেন, ঢাকায় আমরা যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেখছি, এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন কাজ চলছে। এ ধরনের প্রকল্পের উদ্দেশ্যই থাকে টোল কালেকশন করা। সেই বিবেচনায় তারা এক্সপ্রেসওয়ের দর্শন না মেনে ইচ্ছামতো র্যাম্পের জাল ছড়িয়েছে। অনেকটা মাছ ধরার জন্য জাল ছড়ানোর মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগকারীর উদ্দেশ্য সফল। তবে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সেই দর্শনগুলো বোঝা দরকার ছিল। এত র্যাম্প শহরের মধ্যে ওঠানাম করবে, প্রতিটির ব্যবস্থাপনা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কেননা, ঢাকা শহরের গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার; অথচ এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, নিচের সড়কের গতিবেগ প্রায় ৭৫ কিলোমিটার কম। তিনি জানান, বেশি গতিসম্পন্ন গাড়ি চলাচলের অবকাঠামো নির্মাণে খরচ বেশি হয়। যদি সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চলাচল করা না হয়; তা হলে কম খরচে অবকাঠামো নির্মাণ করা যেত। পিপিপিতে দরকষাকষির ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীর চেষ্টা থাকবে, যত বেশি র্যাম্প নামানো সম্ভব তারা নামাবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার দরকার ছিল শহরকে বাঁচানো ও প্রকল্পের দর্শন বিবেচনায় র্যাম্প সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, যেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, শহরের ভেতর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। আর পিপিপি প্রকল্প মাথায় রেখে নকশা করায় জগাখিচুড়ি হয়েছে। এখন এখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই; স্মার্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নাম দিলেও সেখানে এক্সপ্রেসওয়ের বৈশিষ্ট্য থাকছে না। ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে ৩১টি র্যাম্প দিয়ে শহরের নতুন নতুন যানজট স্পট তৈরি করছে। তিনি বলেন, পুরো প্রকল্প চালু হলে নিচের পাশাপাশি ওপরেও যানজট তৈরি করবে। গতিবেগ এখন ৬০ কিলোমিটার আছে, তা আরও কমিয়ে আনতে হবে। এটা তো কোনোভাবেই এক্সপ্রেসওয়ে হতে পারে না। এটা এক্সপ্রেসওয়ের নামে আরেকটা ফ্লাইওভার বা নগরের বিকল্প সড়ক করা হয়েছে। এত বিপুল অর্থ খরচ করে এসব করার কোনো মানে হয় না। ঢাকার যানজট নিরসনে গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। সেতু কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা এক্সপ্রেসওয়ে করেছি, অতিরিক্ত র্যাম্পের কারণে যদি তা ফ্লাইওভার হয়ে যায়; তাতেও আমি কোনো অসুবিধা দেখি না। আর র্যাম্প বেশি দেওয়ার কারণ মানুষ যাতে শহরের ভেতর থেকে ওঠানামা করতে পারে। এটা পিপিপি প্রকল্প হওয়ায় এখানকার টাকা দিয়ে প্রকল্পের খরচ ওঠাতে হবে। সেই বিবেচনায় র্যাম্প বাড়ানো হয়েছে, এতে প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য হারালেও কিছু করার নেই। এখানে গাড়ি চলাচল করছে, আয় হচ্ছে এবং মানুষ সুবিধা পাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত র্যাম্পের কারণে ঢাকার ভেতরে নতুন নতুন যানজট পয়েন্ট তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতে আরও করবে; এই কথারও সত্যতা রয়েছে। তবে সেটা খুব বেশি বলে মনে হয় না। কোনো সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ শতভাগ পারফেক্ট (সঠিক) হয় না। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। নিজেদের টাকায় করতে পারলে আমরা হয়তো বিশেষজ্ঞদের কথামতো ৮ থেকে ১০টি র্যাম্প দিতাম। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পে রুট নির্ধারণ শহরের ভেতর দিয়ে না করে বাইরে দিয়ে করার ব্যাপারেও কথা হচ্ছে। বাইরে দিয়ে করলে তো পিপিপি হতো না। তারা ট্রাফিক না পেলে তো বিনিয়োগ করত না। বিশেষজ্ঞদের মতামতকে আমরা স্বাগত জানাই। তাদের পরামর্শ ও সমালোচনা আমাদের প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করে। ওই প্রকল্পে সব বাস্তবায়ন করতে না পারলেও পরেরবার সেসব আমরা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে পারি।’