দেশে চতুর্থবারের মতো জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালিত হচ্ছে আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানসম্মত তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। পরিসংখ্যান আইন পাশের ফলে জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা (এনএসও) হিসাবে বিবিএস একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সঠিক ও সময়োপযোগী পরিসংখ্যান প্রণয়নে জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ আবশ্যক; তাই পরিসংখ্যানকে আরও জনকল্যাণমুখী ও মানুষের দোরগোড়ায় উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস খুবই প্রয়োজন। দেশে অনেক জাতীয় দিবস পালিত হয়ে থাকে, কিন্তু জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস নেই। বিষয়টি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যস্থাপনা বিভাগে যোগদানের পর থেকেই আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক কর্মরত থাকাকালীন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমি প্রতি বছর ২৭ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস’ হিসাবে উদযাপনের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা বৈঠকে সদয় বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সারসংক্ষেপ প্রেরণ করি। ৮ জুন ২০২০ জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রতিবছর ২৭ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালনের প্রস্তাব যুক্তিসহকারে উপস্থাপন করি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রতিবছর ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখকে জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস হিসাবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফলস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ২৬ আগস্ট সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা তৎকালীন চারটি পরিসংখ্যান সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়। সঠিক, সময়োপযোগী ও মানসম্মত পরিসংখ্যান প্রস্তুত করে দেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসাবে বিবিএস অফিসিয়াল পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও প্রকাশ করে থাকে। জনশুমারি, কৃষিশুমারি, অর্থনৈতিক শুমারিসহ বিভিন্ন ধরনের সার্ভে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করে থাকে বিবিএস। জাতীয় ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে নিয়োজিত পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক, সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এনজিও এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রকাশের দায়িত্ব বিবিএস নিয়মিতভাবে পালন করে আসছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিসংখ্যানের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকার আগারগাঁওয়ে ২ একর ১৪ শতক জমির ওপর নির্মিত একটি সুদৃশ্য ও দৃষ্টিনন্দন পরিসংখ্যান ভবন উদ্বোধন করেন। অতঃপর ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপায়ণের অন্যতম শক্তি ‘পরিসংখ্যান ও তথ্যপ্রযুক্তি’ বিবেচনায় ২০১২ সালে পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত ও গণমুখী করার লক্ষ্যে তিনি বিস্তৃত পরিসরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ‘পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ’। পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান তথা এর আইনগত ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘পরিসংখ্যান আইন, ২০১৩’ জাতীয় সংসদে পাশ হয়। দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান উন্নয়নে জাতীয় কৌশলপত্র (এনএসডিএস) অনুমোদিত হয়। এনএসডিএস হলো পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত একটি বিস্তারিত, বাস্তবসম্মত, অংশগ্রহণমূলক, পরিবর্তনশীল ও রাষ্ট্রীয় স্বত্বাধীন পরিকল্পনা দলিল। বিভিন্ন বিষয়ে অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। এটি শুধু কথার কথা নয়, সঠিক পরিসংখ্যানভিত্তিক নির্ভরযোগ্য তথ্যের আলোকে আজ আমরা উন্নয়নের সূচকগুলো অর্জন করে চলেছি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে এমডিজি বাস্তবায়নের রোল মডেল। এ সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে আগামীতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মাধ্যমে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ সরকার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এসডিজি পরিবীক্ষণে ডেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হালনাগাদ ও Disaggregated Data প্রস্তুতে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কাজ করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৪ মার্চ, ২০১৮ তারিখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিসংখ্যান সরবরাহের ক্ষেত্রে বিবিএসসহ সব উপাত্ত সরবরাহকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের সুবিধার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ অনুমোদনক্রমে সচিব, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নেতৃত্বে ৫০ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় উপাত্ত সমন্বয় কমিটি (National Data Coordination Committee-NDCC) গঠন করা হয়েছে। ৫ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এসডিজি ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তির লক্ষ্যে তথ্য সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত সমন্বয় সাধনের জন্য জাতীয় উপাত্ত সমন্বয় কমিটি (এনডিসিসি) নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে পরিসংখ্যানসংক্রান্ত কার্যাবলী সমন্বয় ও সুসংহত করতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগে বিদ্যমান ‘পরিকল্পনা উইং/অধিশাখা’কে ‘পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান উইং/অধিশাখা’ নামকরণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে বিসিএস পরিসংখ্যান ক্যাডারের ৫৮টি পদ সৃষ্টির জন্য আমি যথাযথ প্রক্রিয়ায় সারসংক্ষেপ প্রেরণ করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৯.১০.২০১৮ তারিখে তা সানুগ্রহ অনুমোদন করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে একজন করে উপপরিচালক/পরিসংখ্যান কর্মকর্তা পদায়ন করা হলে মন্ত্রণালয়/বিভাগের পরিসংখ্যানসংক্রান্ত কার্যাবলীর সুষ্ঠু সমন্বয় করা সহজ হবে এবং পারস্পরিক যোগাযোগ ও পরিসংখ্যানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এর সফল বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। উল্লেখ্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নির্ভুল ও সময়োচিত পরিসংখ্যান প্রণয়নে বিবিএসসংশ্লিষ্ট সবার আস্থা ও প্রশংসা অর্জনসহ দেশের অফিশিয়াল পরিসংখ্যান প্রস্তুতের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবিএসের জনবলের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিকল্পে জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির দুটি ফ্লোর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিক্স অ্যান্ড রিসার্চ (বিআইএসআর) হিসাবে ব্যবহারের জন্য সানুগ্রহ অনুশাসন প্রদান করেছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নিয়োগ, পদোন্নতিসহ সব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০১৯’ চূড়ান্তভাবে অনুমোদনক্রমে ১৮ মে ২০১৯ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাঠ পর্যায়ের সব কার্যক্রমকে গতিশীল ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালে বিবিএসের মাঠ পর্যায়ের জেলা ও বিভাগীয় অফিসগুলোয় গাড়ি সরবরাহ করা হয়েছে। ২০২০ সালে মাঠ পর্যায়ের উপজেলা ও থানা পরিসংখ্যান অফিসগুলোয় মোটরসাইকেল ও নারী কর্মকর্তাদের জন্য স্কুটি সরবরাহ করা হয়েছে। এটি বিবিএসের জন্য কম গৌরবের কথা নয়। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে যোগদানের পর থেকে আমার ভাবনায় ছিল এ ভবনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করার বিষয়টি। এ বিষয়ে আমাকে বিবিএসের কয়েকজন সহকর্মী সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। জাতির পিতার হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠান, তথা পরিসংখ্যান ভবনের লবিতে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতাকে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি), ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিবিএসের বস্তুনিষ্ঠ ও সময়োচিত পরিসংখ্যান সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও বেগবান করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এ প্রত্যাশা করি। সঠিক পরিসংখ্যান চর্চার আকাক্সক্ষায় শুরু হোক আগামীর স্বপ্ন। সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী : সংসদ-সদস্য sauren.chak@gmail.com