বরিশালের মুলাদীর মাউলতলা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুর রশীদ মিয়া অবসরে গেছেন ২০২০ সালের ১ মার্চ। ইতোমধ্যে তার অবসর জীবন চার বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অবসর ভাতা ও প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা পাননি তিনি। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন রংপুরের পীরগঞ্জের বটেরহাট দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হারুন রশীদ। তার টাকাও এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। এই দুই শিক্ষক কবে নাগাদ তাদের অবসর ভাতা পাবেন সেটি অনেকটাই অনিশ্চিত। অন্যদিকে বগুড়ার শান্তাহারের শহিদ লে. আহসানুল হক ডিগ্রি কলেজে চাকরি করতেন ফেরদৌস হোসেন পিন্টু। ২০২১ সালে ২১ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তিন বছর পার হয়ে গেলেও পিন্টুর পরিবার এখনো তার অবসর সুবিধা পায়নি। অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অবসর ভাতা পেয়ে যান। বেসরকারি শিক্ষকরা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশীদ ও পিন্টুর মতো ৩৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী তাদের অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তাদের পাশাপাশি আরও সাড়ে ২৬ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ঘুরছেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থের জন্য। সবমিলিয়ে প্রায় ৬২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আর্থিক দাবি ঝুলে আছে। এজন্য অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন। চাকরি ছাড়ার পর এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের পাওনা টাকা না পাওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে অনেকের শেষ জীবন। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সে চিকিৎসা দরকার। কারওবা সন্তানের লেখাপড়া কিং মেয়েকে বিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে সবই আটকে আছে কিংবা ধারদেনা করে কাটাতে হচ্ছে। অবসরে যাওয়ার পর টাকা না পেয়ে মারা গেছেন অনেকে। এছাড়া অনেকে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অবসর বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী বলেন, আমাদের প্রতি মাসে আবেদন অনুযায়ী চাহিদা রয়েছে ১১০ কোটি টাকা। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীর মূল বেতন থেকে প্রতি মাসে ৬ শতাংশ অর্থ কেটে আয় হয় ৭৫ কোটি টাকা। এতে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ৩৫ কোটি টাকা। এতে আবেদনের জট পড়েছে ৩৫ হাজারের মতো। এটা নিষ্পত্তি করতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। বোর্ডের তহবিল সংকটের কারণে অবসর সুবিধা পেতে শিক্ষকদের মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে অতিরিক্ত অর্থ চাওয়া হয়েছে। সেটি বরাদ্দ পেলে অনেক শিক্ষকের দাবি মেটানো সম্ভব হবে। এছাড়া অনেক মানবিক আবেদন আসে সেগুলো মেটাতে হয়। সবকিছু মিলে আবেদনের জট দিন দিন বাড়ছে। জট দূর করতে দুই বোর্ডে ৬ হাজার কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজন। কল্যাণ টাস্টের সচিব শাহজাহান আলম সাজু বলেন, অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টে শিক্ষক-কর্মচারীর মূল বেতন থেকে প্রতি মাসে ৪ শতাংশ অর্থ কর্তন করা হয়। এতে নিয়মিত কিছু আয় আসে। কিন্তু প্রতি মাসে যে পরিমাণ আবেদন আসে, সেই তুলনায় বরাদ্দ নেই। ফলে প্রতি মাসে অনেককে বিদায় করার পরও বেশিরভাগ দাবি অনিষ্পন্ন থেকে যাচ্ছে। এভাবে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর জট বাড়ছে। এখন বিশেষ ও এককালীন বড় বরাদ্দ না করা হলে শিক্ষকদের ঘুরতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে এমপিওর (বেতন-ভাতা) মতোই অবসর-কল্যাণ খাতে পৃথক বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। জানা গেছে, অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে আয়ের উৎস হচ্ছে এমপিও খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের দেওয়া চাঁদা এবং স্থায়ী আমানত থেকে পাওয়া লভ্যাংশ। কিন্তু এই আয়ের তুলনায় ব্যয়ের চাহিদা অনেক বেশি। অবসর বোর্ড বর্তমানে ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসের আবেদনকারীদের অর্থ পরিশোধ করছে। অবসর সুবিধা হিসাবে একজন শিক্ষক গড়ে ১২ লাখ আর একজন কর্মচারী ৬ লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন। কলেজের অধ্যক্ষ সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পান। এতে অবসর বোর্ডে বছরে প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৩২০ কোটি কিন্তু আয় হয় ৮৭৬ কোটি। এতে বছরে ঘাটতি থাকে ৪৪৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে, কল্যাণ ট্রাস্টে শিক্ষকরা গড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। অর্থের পরিমাণ কম হওয়ায় এই সংস্থায় আবেদনের জট অবসর বোর্ডের চেয়ে তুলনামূলক কম। এরপরও অর্থের অভাবে দাবি সব মিটছে না। কল্যাণ ট্রাস্টে বর্তমানে সাড়ে ২৪ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন আছে। এসব আবেদন নিষ্পত্তির জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন। এই সংস্থায় শিক্ষকদের দাবি মেটাতে প্রতি মাসে ৬০ কোটি টাকা দরকার। কিন্তু চাঁদা আর এফডিআর থেকে প্রাপ্ত আয় আসে মাসে ৪৮ কোটি টাকা। বছরে ঘাটতি থাকে ১৪৪ কোটি টাকা। ২০০২ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু শুরু থেকেই এই অবসর সুবিধা বোর্ড চরম অবহেলিত। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই বোর্ডের এফডিআর ছিল মাত্র ৮৯ কোটি টাকা। এটা থেকে নামমাত্র আয় ছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সদস্য সচিব হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা দেওয়া হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকে টাকা জমা হলেও সঙ্গেসঙ্গে এই টাকা অবসরপ্রাপ্তদের দেওয়া হয়না। এই টাকা পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এছাড়া দুই বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংকের গোপন আঁতাত রয়েছে বলে জানা গেছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের এই সমস্যা দূর করতে নিয়মিত বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।