রাজধানীর অনুমোদিত ভবনগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ নকশায় বিচ্যুতি করা হয়েছে। কোনো ভবনের চারপাশের খালি জায়গা না ছেড়ে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আবার কোথাও ফায়ার এক্সিট রাখা হয়নি। কেউবা অফিসের অনুমোদন নিয়ে রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছেন। অনুমোদনের চেয়েও বেশি তলা নির্মাণের ঘটনাও অহরহ। বছরের পর বছর এসব বিচ্যুতি হলেও তা প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ কারণে ঢাকার ভবনগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠছে, প্রায়ই বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। অকালে ঝরে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ। এদিকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন রাজউকের একজন অথরাইজড অফিসার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আসল জায়গায় কেউ হাত দিচ্ছে না। ভবন নির্মাণে ব্যত্যয় বা ত্রুটি দূর করতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী শুধু অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক করলে সব অনিয়ম রাতারাতি ঠিক হতে বাধ্য। তিনি বলেন, অনুপেন্সি সার্টিফিকেট হলো ভবন ব্যবহার করার অনুমতিপত্র। অর্থাৎ ভবন নির্মাণ শেষ হলে তা ব্যবহার করার জন্য ভবন মালিককে রাজউক থেকে এই সনদ নিতে হবে। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরেজমিন যাচাই করার পর এ সনদ দেবেন। আবার এ সনদ ছাড়া কোনো সেবা সংস্থার ইউটিলিটি সেবা তথা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিতে পারবে না। অথচ এ সনদ যাচাইয়ের কোনো প্র্যাকটিস হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকশা অনুমোদন নেওয়ার পর তারা কীভাবে ভবন নির্মাণ করছে, তা দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের। মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শকদের দায়িত্ব ভবন নির্মাণকাজ সরেজমিন পরিদর্শন করে নকশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা। আইনে এমন দায়িত্ব দেওয়া থাকলেও রাজউক তা করে না। এ সুযোগে নকশার বিচ্যুতি ঘটছে। আর বিচ্যুতিকারীদের বিরুদ্ধেও কঠোর শাস্তি না হওয়ায় ভবন নির্মাতারা নকশায় বিচ্যুতি করতে পিছপা হন না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভবনের নকশার অনুমোদন দেয়। নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, সেটাও রাজউকের নিশ্চিত করার কথা। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত এ সংস্থা বলছে, রাজউক এলাকায় ৫ লাখ ১৭ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন রয়েছে ২ লাখের। অনুমোদিত ভবনের মধ্যে ৯০ শতাংশ নকশার বিচ্যুতি করেই ভবন নির্মাণ করেছে। রাজউক এসব ভবনের বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণে বছরে গড়ে ৫ হাজার নোটিশ দিয়ে থাকে। গত বছর রাজউকের পক্ষ থেকে বিচ্যুতি প্রতিরোধে ১ হাজার ৮৯০টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরপরও নকশার বিচ্যুতি থেমে নেই। কারণ, অনেক সময় নানা কারণে রাজউক কার্যকর শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আইন মেনে ভবনের নকশা অনুমোদন হচ্ছে। এতে কোনো ত্রুটি থাকে না সাধারণত। তবে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা মানা হচ্ছে না। এটা দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের ভবন পরিদর্শকদের। সরেজমিন পরিদর্শন করে নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ বাস্তবায়ন কাজ তাদের নিশ্চিত করার দায়িত্ব। কিন্তু তারা সেটা করছেন না। অনেক সময় বিশেষ সুবিধা নিয়ে ভবন মালিকদের স্কয়ার ফুটে বাড়তি সুবিধা করে দিতে গোপন সমঝোতা হয়। মূলত এভাবেই বেশি ক্রাইম হচ্ছে। তিনি বলেন, রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কাজে মনোযোগ দেন না। তারা হাউজিং ও অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগী। তারা ফ্লাইওভার নির্মাণ করছেন। খাল ও লেক নির্মাণ করছেন। অথচ তাদের মূল কাজ সঠিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু রাজউকের নিয়ন্ত্রণকদের সেসব কাজে মনোযোগ দেখা যায় না। রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা বলেন, রাজউকের ভবন নির্মাণের ত্রুটির প্রধান কারণ পরিদর্শকদের অবহেলা। কখনো তারা নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। আবার ভবন মালিকের কাছে ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছেন। এসব দুর্বলতায় রাজউকের অনুমোদিত নকশার ৯০ ভাগের বেশি বিচ্যুতি ঘটছে। এসব দুর্বলতা নিরসনে রাজউককে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজউকের পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও প্রকৌশলীরা জড়িত থাকেন। তাদেরও এক্ষেত্রে দায়বদ্ধ করতে হবে। শুধু পরিদর্শকদের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। ‘গ্রিনকজি কটেজ’ ভবনের নির্মাণ ত্রুটি : ২০১১ সালে গ্রিনকজি কটেজ ভবনের নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক। একটি বেসমেন্টসহ আটতলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই জমির মালিক হামিদা খাতুন। আর ওই ভবনের ডেভেলপমেন্ট কাজ করে আমিন মোহাম্মদ। যেভাবে রাজউক অনুমোদন দিয়েছে, সেভাবে ভবন নির্মাণ হলেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ত্রুটি রয়েছে। গ্রিনকজি কটেজ ভবনের নিচতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত অফিস হিসাবে ব্যবহার করার কথা। আর উপরের দুই তলা আবাসিক হিসাবে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু নির্মাণের পর ভবন বা স্পেসের মালিকরা অনুমোদনের শর্ত লঙ্ঘন করেছেন; অফিস ও আবাসিকের পরিবর্তে ওই ভবনে তারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অগ্নিনির্বাপণের শর্তগুলোও তারা যথাযথভাবে মানেননি। তবে এসব ত্রুটির জন্য ওই ভবন মালিককে কখনো নোটিশ করেনি রাজউক। জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক বলেন, ‘ওই ভবনের নকশা ও ব্যবহারের বিষয় যাচাই-বাছাই করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমিও ওই কমিটির সদস্য আছি। আমরা কাজ শুরু করেছি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ওই ভবন মালিককে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল বলে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাইনি।’ রাজউক যা বলল : রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মিডিয়া মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজউক এলাকায় ২ লাখের মতো ভবন তৈরি হয়েছে নকশা অনুমোদন নিয়ে। এর মধ্যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশে নকশার বিচ্যুতি করা হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে রাজউক ৫ হাজার ভবন মালিককে ভবনের ত্রুটি সংশোধনে নোটিশ দিয়েছে। সবশেষ গত বছর ১ হাজার ৮৯০টি ভবনের বিরুদ্ধে অভিযানও পরিচালনা করেছে। চলতি বছরেও নকশার বিচ্যুতি করা ভবনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। রাজউকের একজন কর্মকর্তা শনিবার বলেন, ৯০ শতাংশ ব্যত্যয়ের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, সেটি মূলত বেসরকারি বা ব্যক্তিপর্যায়ের ভবনে বেশি হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পে ব্যত্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, পদে পদে যাচাই সনদ নিতে হয়। স্বনামধন্য বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে ১০ শতাংশের বেশি ব্যত্যয় হয় না। কিন্তু যারা ব্যক্তিপর্যায়ে ভবন নির্মাণ করছেন, তাদের অনেকে আগে নকশা ছাড়াই ভবন নির্মাণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রশ্নে অনেকে বাধ্য হয়ে নকশা নিয়েছেন। আবার এদের একটা বড় অংশ ভবন নির্মাণের সময় সুবিধামতো ব্যত্যয় করেছেন। যেমন: রাজউকের নকশায় যদি দেওয়া হয় ১২শ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, তারা বাস্তবে বানিয়েছেন ১৬শ স্কয়ার ফুট। এসব করতে গিয়ে ফায়ার এক্সিট ছাড়াও নানারকম ব্যত্যয় করা হয়।