উৎসবমুখর প্রচার শেষে চলছে হিসাব-নিকাশ

প্রকাশিতঃ মার্চ ৮, ২০২৪ | ৯:১৬ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন (মসিক) নির্বাচনে উৎসবমুখর প্রচারণার শেষ দিনে (বৃহস্পতিবার) মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে উঠেছিল গোটা নগরী। প্রার্থীরা নিয়েছেন ভোটারদের শেষ দোয়া। কেউ মাথায় হাত রেখেছেন আবার কেউ বুকে টেনে নিয়েছেন আবার কোনো কোনো প্রার্থীকে কদমবুচি করতেও দেখা গেছে। শেষ দিনে সব প্রার্থী তাদের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দফায় দফায় ঘুরে ফিরছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। এলাকার উন্নয়নে দিয়েছেন নানা প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যেও চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা, হিসাব-নিকাশ। তারা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। এবার মেয়র পদে পাঁচজন, ৩৩টি সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৯ জন ও ১১টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৯ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাধারণ ভোটার ও স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মেয়র প্রার্থীদের সবাই নির্বাচনি নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচারণা চালালেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত আওয়ামী ঘরোনার তিন প্রার্থীর সঙ্গে। তারা হলেন-মেয়র পদে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু, হাতি প্রতীকের প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদেকুল হক খান (সাদেক খান মিল্কী টজু) ও ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এহতেশামুল আলম। এছাড়া মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির শহিদুল ইসলাম এবং হরিণ প্রতীকে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা রেজাউল হক। প্রচারের শেষ দিনে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটু বিকালে লিফলেট হাতে নিয়ে নগরীর বাঁশবাড়ী কলোনি, আর কে মিশন রোড ও ধোপাখলা এলাকাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ফিরেছেন। কখনো হাত ধরে, কখনো বুকে টেনে আবার কখনো কোলাকোলি করে কুশল বিনিময় করেন এবং ২৩ দফা ইশতেহারের লিফলেট তুলে দিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন। অপরদিকে হাতি প্রতীকের প্রার্থী সাদেকুল হক খান টজু বিকালে নগরীর নাটকঘরলেন, ছোটবাজার, বড়বাজার, মেছুয়া বাজারসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় তিনি গ্রিন সিটি ও ক্লিন সিটি গড়তে ভোট ভিক্ষা চান। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের হাতে তুলে দেন ১৫ দফা উন্নয়নের ইশতেহার সংবলিত লিফলেট। এছাড়া ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী এহতেশামুল আলম মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। তিনি নগরীর উন্নয়নে ২০ দফা ইশতেহার সংবলিত লিফলেট বিতরণ করে বেড়ান নগরীর কলেজ রোড, কাঁচিঝুলি, আমলাপাড়া, স্টেশন রোডসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে। এছাড়া কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দফায় দফায় ঘুরে ফিরছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। ওয়ার্ডবাসী নাগরিক সেবা বাড়াতে তুলে দিয়েছেন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি সংবলিত লিফলেট। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ময়মনসিংহ পৌরসভার শেষ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করায় সেই নির্বাচনটি ছিল উৎসবমুখর ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের। সেখানে বিএনপি নেতা অধ্যাপক শফিকুল ইসলামকে হারিয়ে জয়লাভ করেন ইকরামুল হক টিটু। তখন বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাবেক ধর্মমন্ত্রী মরহুম অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী ঘরোনা ছিল টিটুর পক্ষে একক বলয়ে। ২০১৮ সালে ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন গঠনের পর মেয়র ইকরামুল হক টিটু প্রথমে প্রশাসক মনোনীত হন এবং পরে মসিকের প্রথম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইকরামুল হক টিটু মেয়র নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে শুধু কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তেমন উৎসবমুখর ছিল না। আর এবার বিএনপি মাঠে না থাকায় এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় মসিক নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এবং শক্ত প্রতিপক্ষ। আর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে তিন প্রার্থীর পক্ষে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নগরবাসীর ধারণামতে, দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ময়মনসিংহ পৌরসভা ও বর্তমান সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটু নিজেকে গুছিয়ে রেখেছেন। আওয়ামী লীগের অপর দুই প্রার্থী-সাদেকুল হক খান টজু ও এহতেশামুল আলম দুজনই সদর আসনের এমপি মোহিত উর রহমানের পন্থি হওয়ায় তাদের ভোট ভাগাভাগি হওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রার্থী দুজনেরই অবস্থান ও বক্তব্য তাদের শক্ত প্রতিপক্ষ টিটুর বিরুদ্ধে। এছাড়া মেয়র পদে অপর দুই প্রার্থী লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টির শহিদুল ইসলাম ও হরিণ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল হকের প্রচার-প্রচারণা তেমন একটা নেই। এদিকে চায়ের আড্ডা, হোটেল, পার্ক, রেস্তোরাঁ সব স্থানে প্রার্থীদের নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। নানা হিসাব-নিকাশ করছেন ভোটাররা। কে ভালো, কে মন্দ এ নিয়ে চলছে নানা মুখরোচক আলোচনা। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরীর বেশির ভাগ বাসিন্দা ও ভোটার মনে করেন, টেবিল ঘড়ি প্রতীকের ইকরামুল হক টিটু ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে তৎকালীন পৌরসভার প্যানেল চেয়ারম্যান, এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, তারপর ২০১২ সালে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মসিক গঠনের পর প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পান টিটু। এরপর মসিকের প্রথম নির্বাচনে আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করায় তিনি বেশ সদালাপী, সব অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ও অভিজ্ঞ জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে নগরবাসীর নজর কেড়েছেন। স্থানীয়রা আরও জানান, নগরবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা যানজট, অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ না করা, নগরীর রাস্তা সংস্কার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন, জলাবদ্ধতা, উচ্চ হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও যত্রতত্র বহুতল ভবনের অনুমোদন নিয়ে নানা বিতর্কও রয়েছে। আর এসব বিষয় নিয়েই এবারের নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষরা বিষোদগার করছেন। তার নির্বাচনি প্রচারণায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলসহ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ নাঠে নেমেছেন। নগরবাসীর নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে ইকরামুল হক টিটু বলেন, নগরবাসীর সেবা অব্যাহত রাখতে চাই। অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে চাই। পরিকল্পনাবিদদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরীর রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন অনেকাংশে হয়েছে। যানজট নিরসন ও নাগরিক সুবিধা বাড়াতে আবারও মেয়র হিসাবে ভোটারদের রায় চান তিনি। প্রতিপক্ষ হাতি প্রতীকের প্রার্থী শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদেকুল হক খান। নগরীতে তিনি ক্লিন ইমেজের মানুষ। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা হিসাবে তারও রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্তর পক্ষে নির্বাচনি প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বড় একটি অংশ তার পক্ষে প্রচারণায় নেমেছেন। আশীর্বাদ রয়েছে নব্য এমপি মোহিত উর রহমান শান্তরও। সংসদ নির্বাচনে টিটুর বড় ভাই আমিনুল হক শামীম স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হওয়ায় ওই বলয়ে গরম হাওয়া বইছে। দীর্ঘদিন পর ভোটের মাঠে সক্রিয় থাকায় তার নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও কিছুটা অক্সিজেন পাচ্ছে বলা যায়। ফলে এমপিপন্থি প্রার্থী টজু সমর্থকদের ধারণা, সিটি নির্বাচনেও বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন তারা। এদিকে এমপি নির্বাচনের পর থেকে নগরবাসীর ধারণা, টিটুর শক্ত প্রতিপক্ষ টজু। টজু বলেন, টিটু দীর্ঘদিন নগরবাসী সেবা করার দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি অপরিকল্পিতভাবে রিকশা-অটোরিকশার লাইসেন্স দিয়ে যানজট সৃষ্টির মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে ময়মনসিংহ আজ ধীরগতির শহর। জলাবদ্ধতা, উচ্চ হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও যত্রতত্র বহুতল ভবনের অনুমোদন নিয়ে এখন নানা বিতর্ক। নগরবাসী এবার পরিবর্তন চায়। তিনি বলেন, নগরীর উন্নয়ন আর নগরবাসীর সেবার ১৫ দফা ইশতেহার নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছি। আশা রাখি নগরবাসী আমাকে বিজয়ী করবে। অপরদিকে ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সংগঠক এহতেশামুল আলম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাজনীতির মাঠে বেশ সরব। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে শান্তর পাশে ছিলেন। ফলে তাকে নিয়েও নানা আলোচনা ও সমালোচনায় মুখর নগরবাসী। তাকে টিটুর শক্ত প্রতিপক্ষ হিসাবেও মনে করছেন কেউ কেউ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমপির সমর্থনটি পাননি তিনি। ফলে ‘একলা চলো’ নীতিতে ভর করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজের যোগ্যতা, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও নগরবাসীর নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাবেক ও বর্তমান কতিপয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ফিরছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। ভোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছেন লিফলেট। ভোটারদের বিষোদগার করছেন শক্তিশালী অপর দুই প্রার্থীর নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে। এহতেশামুল আলম বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর টিটু দায়িত্ব পালন করেছেন। নগরবাসী সুফল পায়নি। অনিয়ত্রিতভাবে অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়ায় যানজটে নগরবাসী। নগরীর রাস্তা ও ড্রেনেজ সিস্টেমের কাজ সবই করছে তার লোকজন। উচ্চ হোল্ডিং ট্যাক্স ও যত্রতত্র বহুতল ভবনের অনুমোদন নিয়েও নানা বিতর্কও রয়েছে। তিনি বিজয়ী হলে নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সব সমস্যার সমাধাকল্পে উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন এবং দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন গড়বেন। সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৭২ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৭২ হাজার ৬১৫। নির্বাচনে একজন রিটার্নিং অফিসার ও সাতজন সহকারী রিটার্নিং অফিসার। অতিরিক্তসহ ১৩৪ জন প্রিসাইডিং অফিসার ও এক হাজার ৪০ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং দুই হাজার ৭৯ জন পোলিং অফিসার নিয়োজিত থাকবেন। মোট ভোটকেন্দ্র ১২৮ ও ভোটকক্ষের সংখ্যা ৯৯০টি। মেয়র পদে পাঁচজন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৯ জন ও ১১টি সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৬৯ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১১নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফরহাদ আলমকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে।