চীনের ঋণ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের মত চেয়েছে ইআরডি

প্রকাশিতঃ মার্চ ৮, ২০২৪ | ৯:১৯ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

চীনের ঋণ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ওই দেশটির মুদ্রা ‘ইউয়ান’-এ গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় মতামত দিতে অর্থ বিভাগের কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। ইআরডি সূত্রে জানা যায়, এর আগেও উল্লিখিত বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছিল ইআরডি। কিন্তু মতামত না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় তাগিদ দেওয়া হয়। সরকারি অফিসগুলোয় ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পে চীনের ৩ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা এবং প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) অর্থ চীনা মুদ্রায় নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ সাধারণত মার্কিন ডলারে ঋণ পরিশোধ করে। কিন্তু চীনের ঋণে সুদহার কম থাকায় রিজার্ভ থেকে ইউয়ান কিনে ঋণ পরিশোধ করলে দেশের অর্থ সাশ্রয় হবে। এতে রিজার্ভ ক্ষয়ও কমবে। এ ঋণের আওতায় পণ্য আমদানির সময় এর সঙ্গে অন্যান্য দেশের তুলনামূলক দর যাচাই করতে হবে। চীন থেকে কেনা পণ্যের দাম যদি অন্য দেশের তুলনায় কম বা সমান হয়, তা আমাদের জন্য ভালো হবে। চীনা ঋণ আমাদের এমন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে, যার মাধ্যমে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ে। যদি এই ঋণের অর্থ অবকাঠামোর পেছনে ব্যয় হয়, তাহলে সেখান থেকে আমাদের আউটপুট হবে অল্প, যা ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী জানান, ইউয়ান মুদ্রায় ঋণ নিতে পারে। এতে রিজার্ভের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, চীন থেকে পণ্য আনতে আমাদের বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। সেখানে এ মুদ্রা ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি ঋণের অর্থ পরিশোধেও ইউয়ান ব্যবহার করা যেতে পারে। জানা যায়, ১৩ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে। সেখানে চীনের অর্থায়নে এস্টাবলিশিং ডিজিটাল কানেক্টিভিটি (ইডিসি) প্রকল্পের সম্পূর্ণ অর্থসহ অন্যান্য প্রেফারেন্টাল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) প্রকল্পের ঋণ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে আরএমবি মুদ্রায় গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। মতামত দ্রুত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এ বিষয়ে আগেও মন্ত্রণালয়ের মতামত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি তা পাওয়া যায়নি। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চীনের ঋণ বিধিমালার আওতায় প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের অর্থ দিয়ে ৬৫ শতাংশ নির্মাণসামগ্রী চীন থেকে কিনতে হয়। আর ৪০ শতাংশ ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম চীনের বাইরে থেকে কেনা যায়। তবে অন্য দেশ থেকে কিনলেও ইউয়ানেই আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলার দিয়ে ইউয়ান কিনতে হবে। এতে মুদ্রা রূপান্তরের ঝুঁকি আছে এবং তাতে প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয়ও বাড়তে পারে। চীন থেকে দেশের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার। সে তুলনায়, আমদানি ব্যয় প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর এ বাণিজ্য ডলারেই হয়ে থাকে। জানাতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, চীনের ঋণ ইউয়ানে নেওয়া হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইউয়ান যোগ হবে। এতে বিভিন্ন ধরনের খরচ ইউয়ানে করা যাবে। বিশেষ করে চীনের ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অনেক কিছুই চীন থেকে আমদানি করতে হবে। এক্ষেত্রেও ইউয়ান ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া প্রকল্পের বাইরে সারা বছর চীন থেকে আমাদের অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। সেখানেও ইউয়ান ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক হবে। এখন ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পে ঋণ ইউয়ানে নেওয়ার কথা উঠে আসছে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের অর্থায়ন ৩ হাজার ৩৭৮ কোটি এবং বাকি ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা সরকারি অর্থায়ন। এ প্রকল্পের মধ্যে সারা দেশে ১ লাখ ৯ হাজার ২৪৪ ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেওয়া হবে সরকারি অফিসগুলোয়। এছাড়া ১০ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, ৫৭টি বিশেষ আইটি ল্যাব, ৫৫৫টি ডিজিটাল সার্ভিস ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ২১টি স্টোরওয়ে টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প ছাড়াও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের চিঠিতে প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের অর্থও ইউয়ানে নেওয়ার বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। চীন সরকার সাধারণত দুধরনের ঋণ দেয়, এর একটি হলো মার্কিন ডলারে প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) এবং অপরটি নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল) বা সরকারিভাবে দেওয়া রেয়াতি ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। তাই চীন থেকে ডলারে ঋণ নিলে বাংলাদেশকে প্রায় ৬ শতাংশ হারে সুদ দিতে হতো। সে তুলনায় ইউয়ানে ঋণের খরচ মাত্র ২.৫ শতাংশ, অর্থাৎ সুদহারের বিবেচনায় এটি বড় সুবিধা। সূত্রমতে, দেশে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ কোটি ইউয়ান (প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলারের সমান) ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে মূল ও সুদসহ ৩২০ কোটি ইউয়ান পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে চীনা অর্থায়নের ১০টি প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি প্রকল্পের অনুকূলে প্রস্তাবিত ৯৪৯ কোটি ইউয়ান (প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার) ঋণ নিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। এসব ঋণ নেওয়া হলে চীনা মুদ্রায় বাংলাদেশের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৪ হাজার ৫৮৪ কোটি ইউয়ানে। ২০১৬ সাল থেকে ইউয়ান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) বাস্কেটের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এর আগে চীন থেকে নেওয়া ইউয়ানভিত্তিক ঋণের বিপরীতে ২০১৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩.৬৬ বিলিয়ন ইউয়ান পরিশোধ করেছে। ফলে ভবিষ্যতে ইউয়ানে নেওয়া ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।