ঘিঞ্জি জনপদ ভেঙে ‘ভূমি পুনঃউন্নয়ন’ করে আধুনিক নাগরিক সেবা দিচ্ছে সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশ। পুরান ঢাকায় বিশ্বের স্বীকৃত ওই পদ্ধতির বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে পদে পদে বাধার মুখে পড়ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ২০১৯ সালে বংশালে দুটি ‘ভূমি পুনঃউন্নয়ন’ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেনি। এরপর হাজারীবাগে একই উদ্যোগ নিয়েও বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে ওই এলাকার যানজট, জলজট নিরসন হবে। সড়ক প্রশস্ত হবে, উন্মুক্ত স্থান ও খোলা জায়গার পরিমাণ বাড়বে। পরিকল্পিত এলাকা হয়ে উঠবে ঘিঞ্জি এই জনপদ। সেখানে মিলবে আধুনিক সব নাগরিক সেবা। বাড়বে ওই এলাকার মর্যাদাও। তবুও হাজারীবাগের বাসিন্দারা নতুন এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। বলছেন, হাজার বছরের বসতভিটা কাউকে দেবেন না। এসব নিয়ে জনপ্রতিনিধিরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। নগর-পরিকল্পনাবিদদের মতে, জমি অধিগ্রহণ ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভূমি পুনঃউন্নয়ন বা রি-জেনারেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। ছোট প্লটগুলো একত্র করে পরিকল্পিতভাবে ওই এলাকা গড়ে তোলা হয়। অনেক জায়গায় একত্র করে প্রকল্প করার ফলে বহুতলবিশিষ্ট ভবন করা যায়। ফলে ছোট প্লটের মালিকরা এককভাবে উন্নয়নের চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি বড় সড়ক, উন্মুক্ত জায়গা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায়। তাদের মতে, বাস উপযোগিতার বিবেচনায় ঢাকা বিশ্বের খারাপ শহরগুলোর তালিকায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে। জনঘনত্বের বিবেচনায় পুরান ঢাকা বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। পুরান ঢাকায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ইট-পাথরের জঞ্জালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলো একমাত্র ভূমি পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে মুক্তি মিলবে পুরান ঢাকাবাসীর। বাংলাদেশের নগর-পরিকল্পনায় ভূমি পুনঃউন্নয়নের নতুন চর্চা শুরু হলেও এটি বাস অনুপযোগী এলাকাকে বাসযোগ্য করার জনপ্রিয় সমাধান পদ্ধতি। নগরবাসী, জনপ্রতিনিধি ও সরকার সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা করতে হবে। সবাই মিলে ঢাকাকে বাস উপযোগী করতে কাজ করতে হবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজউকের সংশোধিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ভূমির পুনঃউন্নয়নের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনার আলোকে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রাজউক পুরান ঢাকা এলাকায় একটি ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এরই অংশ হিসাবে প্রথমে পুরান ঢাকার বংশালে ২০১৮ সালে ৩০ বিঘা ও ১০ বিঘা আয়তনের দুটি প্রকল্পের জন্য জায়গা চিহ্নিত করে। পুরান ঢাকাবাসীকে বিষয়টি বোঝাতে রাজউক নগর পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে একাধিক মতবিনিময় সভাও করে। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সঙ্গেও একাধিক সভা করে। এরপরও এলাকাবাসী রাজউকের প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। নগরপিতাও তাদের বোঝাতে অক্ষম হন। অনেক চেষ্টায়ও ব্যর্থ হয়ে ফেরে উদ্যোগী সংস্থা রাজউক। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বংশালের মানুষকে বোঝাতে না পেরে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাজউক হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকার ভূমি পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগ নেয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে রাজউক হাজারীবাগের ট্যানারির মালিকদের প্রতিনিধি ও নগরপরিকল্পনাবিদদের নিয়ে মতবিনিময় করে। এরপরও একাধিক মতবিনিময় সভা করেছেন ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে। রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী হাজারীবাগ এলাকাকে মিশ্র অঞ্চল (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়। সেই পরিকল্পনার আলোকে রাজউক হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকাসহ আশপাশের প্রায় ১০০ একর জায়গা নিয়ে প্রকল্প নকশা করে। তার আলোকে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করছিল। এসব খবর জানতে পেয়ে গত বছরের ১৯ অক্টোবর হাজারীবাগের বাসিন্দারা ডিএসসিসিতে স্মারকলিপি দেয়। এলাকাবাসী সংক্ষুব্ধ হওয়ায় ডিএসসিসি থেকে রাজউককে অনুরোধ করা হয়-প্রকল্পে কী থাকছে, তা জানাতে। তারই অংশ চলতি মাসের ২২ তারিখে রাজউক ডিএসসিসির সঙ্গে সভা করেছে। সেখানে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছে। ওই সভায় ডিএসসিসির অনুরোধে ১০০ একর এরিয়া থেকে রাজউক সরে এসে ৬১ একর জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ট্যানারি অধ্যুষিত এলাকাজুড়ে এখন রাজউকের হাজারীবাগের ভূমি পুনঃউন্নয়ন এলাকার সীমানা। তবুও এমন সিদ্ধান্তে আস্থা রাখতে পারছেন না ওই এলাকার বাসিন্দারা। এই কারণে গত ২৭ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ‘ঢাকা আরবান রিজেনারেশন’ শীর্ষক প্রকল্পে হাজারীবাগের ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের অনুমোদন দিলেও প্রকল্পের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। রাজউক জানায়, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার মাটির স্তর ৮ ফুট থেকে ২০ ফুট গভীর পর্যন্ত দূষিত। ওই এলাকার দূষণ হ্রাস ও পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে সামগ্রিক পরিকল্পনা করা দরকার। হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার ৬১ একর জায়গা অভিজাত ধানমন্ডির খুব কাছাকাছি অবস্থিত। পাশাপাশি শহরের সব অংশের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। এজন্য ওই এলাকাকে সুপরিকল্পিত মিশ্র ব্যবহার এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এই উদ্যোগ ভূমি মালিক ও রাজউক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারে। তা না হলে রাজউক নিজেই তা বাস্তবায়ন করতে পারে অথবা বেসরকারি সহযোগী ও ভূমির মালিকরা রাজউকের নীতিমালা অনুসরণ করেই যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজউক সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্লক ভিত্তিক উপায়ে ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। আর ব্লক এলাকার ন্যূনতম আয়তন হবে ২ একর বা ৬ বিঘা। এতে ভবন মালিকরা ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বা ভবনের আয়তন বেশি পাবে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র আয়তনের প্লটগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা, সেখানে আয়তন কম পাওয়া যাবে, তাতে জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা জানান, হাজারীবাগের ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ওই এলাকার প্রশস্ত সড়ক তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। অভ্যন্তরীণ ও সংলগ্ন সড়কের সঙ্গে উন্নত নেটওয়ার্ক গড়া যাবে। পাশাপাশি জিগাতলা থেকে সাতমসজিদ রোড এ ট্রাফিক এক্সিট পয়েন্ট স্থাপন করা হবে। এর ফলে ঢাকার এই অংশের চলাচল ব্যবস্থা ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। জানতে চাইলে হাজারীবাগের বাসিন্দা ও বসতভিটা মালিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রায়হান চৌধুরী বলেন, কোনো বসতভিটা রাজউকের প্রকল্পের মধ্যে পড়লে সেখানে প্রকল্প করতে দেওয়া হবে না। আমাদের এলাকার আমরাই উন্নয়ন করব, এখানে রাজউককে চাই না। পুরান ঢাকার ভূমি পুনঃউন্নয়নের প্রস্তাবিত এলাকা : প্রাথমিকভাবে পুরান ঢাকার সাতটি এলাকাকে ভূমি পুনঃউন্নয়নের জন্য চিহ্নিত করেছে রাজউক। এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে-মৌলভী বাজার, সোয়ারীঘাট, লালবাগ, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল ও হাজারীবাগ। পাইলট প্রকল্প হিসাবে হাজারীবাগকে বেছে নেওয়া হয়েছে। রাজউক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চায়। নগরবাসী এই প্রকল্পের সুফল বুঝতে পারলে তখন নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে এমনটি মনে করছেন নগরপরিকল্পনাবিদ ও রাজউক সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বহু পুরাতন বা নতুন এলাকা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। মূল বিবেচ্য বিষয় অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। তাহলে ওই এলাকার ভূমি পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে পরিকল্পিত ও বাস উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আদি ঢাকার কিছু এলাকা। অন্যান্য অংশও পরবর্তীতে যুক্ত করা হবে। ঢাকার আদি অংশ পড়েছে ডিএসসিসিতে; সেগুলো হল-২৪, ২৫, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬ ও ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড। নগর পরিকল্পনাবিদরা যা বললেন : জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, বর্তমান অবস্থায় পুরান ঢাকাকে আর রাখা যায় না। ন্যূনতম নাগরিক সেবা নেই। ইট-পাথরের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। সরু সড়ক, কেমিক্যাল কারখানা, ছোট ছোট প্লট, ভবনের গা ঘেঁষে ভবন। পুরান ঢাকাকে আর এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, রাজউক পুরান ঢাকাকে ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় চায়। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এভাবে বদলে গেছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বহু দেশ। বিশ্বে স্বীকৃতি এই পদ্ধতি ঢাকায় বাস্তবায়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। রাজউক এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে বড় চালেঞ্জে পড়েছে। এটা জনপ্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও নগরবাসী সবাই মিলে সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভূমি পুনঃউন্নয়ন পদ্ধতি বিশ্বে স্বীকৃত, এটা সঠিক। ঢাকার চাহিদার আলোকে তার বাস্তবায়ন করা গেলে খুবই ভালো হবে। তবে এজন্য সরকারি সংস্থাকে নগরবাসীর আস্থা অর্জন করতে হবে। নইলে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কর্তৃপক্ষ যা বললেন : জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, হাজারীবাগ ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান। সম্প্রতি আমরা ডিএসসিসির সঙ্গে সভা করেছি। সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের কলা-কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শহরের উন্নয়নের স্বার্থে ডিএসসিসি সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। আর জনবসতি উঠিয়ে কোনো কিছু করতে চাচ্ছে না রাজউক। প্রধানত ট্যানারি ও ট্যানারির সৃষ্ট দূষিত এলাকাকে এই প্রকল্পের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। ওই এলাকার মানুষের অংশগ্রহণ ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, হাজারীবাগে রাজউক ভূমি পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে ওই এলাকার সংক্ষুব্ধরা ডিএসসিসিতে স্মারকলিপি দিয়েছে। এটা নিয়ে এলাকাবাসী ও রাজউকের সঙ্গে ডিএসসিসি আলোচনা করেছে। রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ট্যানারি বা চামড়া শিল্পের দূষিত অঞ্চলকে ভূমি পুনঃউন্নয়নের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। পুরো আয়তন ৬১ একর। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ওই এলাকার জলজট, যানজট নিরসন হবে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। এলাকার সড়ক প্রশ্বস্ত হবে ও গণপরিসর বাড়বে।