যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ্যবস্তুতে সাম্প্রতিক কিছু হামলায় হাত থাকলেও অনেকেই হয়তো ইসমাইল ঘানির নাম শোনেননি। অনেকটা অদৃশ্য থেকেই ইরানের গোপন শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। পূর্বসূরি জেনারেল কাসেম সোলেইমানির মতো তিনিও জনসাধারণ এড়িয়ে চলেন। এমনকি তাকে কাসেম সোলেইমানির পর ইরানের সবথেকে বড় বীর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ডের অপ্রচলিত যুদ্ধ শাখা কুদস বাহিনীর প্রধান ঘানি। তার বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তেহরানের মিত্র ও প্রতিনিধি দলের নেটওয়ার্ক সমন্বয় করার অভিযোগও রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর কুদস সমর্থিত বাহিনীর আক্রমণ বেড়ে গেলে ঘানির দিকে গণমাধ্যম মনোযোগ দেয়। কিন্তু পূর্বসূরি কাসেম সোলেইমানির মত তিনিও জনসাধারণ এড়িয়ে চলেন। ২০২০ সালে ইরাকে বিতর্কিত মার্কিন হামলায় কাসেম সোলেইমানি মারা যান। ১৯৯০-এর দশকে শেষের দিকে শুরু হওয়া কুদস বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে ঘানি দায়িত্ব পালন করেন। এর প্রথম দশকে সোলেইমানিও তাকে নিচের পদে রেখেছিলেন। কিন্তু সোলেইমানির মৃত্যুর আগের বছরগুলোতে ঘানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন। সোলেইমানির মৃত্যু কুদস বাহিনী এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তায় বড় আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সোলেইমানির স্থানে কাউকে নিয়োগ করা অনেক কঠিন। তার সহকারী হিসেবে কাজ করতেন ঘানি। ১৯৮০ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে পর থেকে তারা একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে তারা দু’জন ঘনিষ্ঠ হন। সোলেইমানির মৃত্যুর পর বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন, ঘানি একজন যোগ্য প্রতিনিধি হবেন। ব্যক্তিত্ব ও প্রচারের দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা দুজন ভিন্ন। তারপরও সোলেইমানির ২০ বছরের স্বপ্নকে বিস্তৃত করতে চেষ্টা করেন ঘানি। তার অধীনে কুদস বাহিনী ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনি অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন, অর্থায়ন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ তৈরিতে ইরানের অধীনে সোলেইমানির পর ঘানির অবদান সবচেয়ে বেশি। এটি এমন একটি জোট, যা এই অঞ্চলে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন কমিয়ে দিচ্ছে। যদিও ইরানে ফার্সি ও শিয়া মুসলিম পরিচয় ছাড়াও অনেক কট্টরপন্থি দল রয়েছে। এসব সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সোলেইমানি অনেকটা বাস্তববাদ এবং নমনীয়তা প্রদর্শন করেন। যদিও ইরান এসব ক্ষেত্রে চরমপন্থা অবলম্বন করে। তবে সোলায়মনির মতো ঘানিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন অর্জন করেছেন বলে মনে করা হয়। চাপের মুখে ইরানের শত্রুরা একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে আমি লক্ষ্য করেছি, কুদস বাহিনীর বিশেষ যুদ্ধকৌশল এই অঞ্চলের নিরাপত্তার ভূ-চিত্র পরিবর্তন করেছে। এটি অক্ষের মধ্যে থাকা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইরানের শত্রু ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে চাপ তৈরি করছে। কুদস ফোর্সের কমান্ডার হিসাবে ঘানিকে এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে তার বাহিনীকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে। ব্যাপক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ইরানের নিজস্ব কৌশল, সিদ্ধান্তের কারণে এটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার সঙ্গে কুদস বাহিনীর সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না বলে জানান তিনি। তবে হামাসের হামলার বিষয়ে ঘানি প্রকাশ্যে স্বাগত জানান। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইরানের সরকারী বার্তা সংস্থায় ঘানি বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে জায়ানিস্ট শাসকগোষ্ঠীর ঘৃণ্য অপরাধের কারণে হামাস নিজেরাই এ ব্যবস্থা নিয়েছে।... তারা যা করেছে সেটি পরিকল্পিতভাবে ও কার্যকর করা হয়েছে।’ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ঘানির আরও শক্তিশালী হাত রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। গত ২৮ জানুয়ারি ইরাকভিত্তিক ও ইরান সমর্থিত ইসলামিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো জর্ডানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা করে। এর ফলে এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। এই হামলা ইরাক, সিরিয়ায় মার্কিন ও ব্রিটিশদের উসকে দেয়। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ঘানি ইরাকি গোষ্ঠীগুলোকে সাময়িকভাবে মার্কিনবিরোধী হামলা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করেন। তবে এই বিরতি স্থায়ী হয় কি-না তা সময় বলে দেবে। ইয়েমেন সম্পর্কে ঘানির ‘ক্যালকুলাস’; যেখানে হুতিরা বিপজ্জনক বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ইরানের দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধে সশস্ত্র হুতিরা লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজে হামলা চালায়। তারা সাগরে শত শত রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অভিযানের প্রতিক্রিয়া জানায়। ইরানের মদদে হুতিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালালেও সম্প্রতি তাদের তৎপড়তা তেমন চোখে পড়ে না। তবে ঘানি এ অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আবারও একত্র করতে পারবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। হিজবুল্লাহর সঙ্গে ঘানির সম্পর্ক ইসরায়েল, ইরাক ও ইয়েমেনের বাইরেও ঘানি লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে কুদস বাহিনীর সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছেন। কারণ, হিজবুল্লাহ ‘প্রতিরোধের অক্ষে’ ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশীদার। এ সম্পর্ক ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে সম্প্রসারিত হয়। তারা এ অঞ্চলে মার্কিনিদের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে হিজবুল্লাহ প্রতিদিনই সংষর্ষে জড়িয়েছে। হিজবুল্লাহর সাধারণ সম্পাদক হাসান নাসরাল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে বৃহত্তর যুদ্ধে জড়াতে ইচ্ছুক বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি আক্রমণ বন্ধ না করলেও হামলার তীব্রতা কমিয়ে দিয়েছে। লেবাননে বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে গোষ্ঠীটি। এমন ঘোষণা ইরান স্বাগত জানালেও যুদ্ধে জড়ানোর ব্যপারে সতর্ক রয়েছে তেহরান। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহ, ঘানি ও খামেনি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সংকটে হিজবুল্লাহ সম্পর্কে ঘানির ভবিষ্যতের যে কোনো বিবৃতি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। খামেনির সমর্থন নিয়ে ঘানি কাসেম সোলেইমানির তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ব ধারণ করে কুদস বাহিনীর মাধ্যমে ইরানের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সফল হবেন কি না তা সময়ই বলে দিবে। তবে সোলেইমানির মতো না হলেও কুদস বাহিনীর সম্পর্ক পরিচালনার মাধ্যমে ঘানি অনেকটাই শক্তিশালী হয়েছেন। ইতিমধ্যে ঘানির সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে। সাম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যেজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা চলমান রয়েছে। এমন অবস্থায় ঘানির নিজের সক্ষমতা প্রমাণের সুযোগ রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে মোকাবেলা করেও তিনি তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেন। ধীরে ধীরে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ইরানের ক্ষমতা খর্ব করতে চাইলে কুদস বাহিনীর প্রভাব ধ্বংস করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। পক্ষান্তরে ঘানির প্রভাবকে ধ্বংস করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। বলা যায়, ঘানি ইরানের গোপন শক্তিশালী অস্ত্র। সূত্র: এশিয়া টাইমস