দরিদ্র ফুটবল কন্যা ইয়ারজানের গ্রামে আনন্দের বন্যা

প্রকাশিতঃ মার্চ ১৩, ২০২৪ | ৪:৫১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ইয়ারজান বেগমের অসাধারণ নৈপুণ্যে ভারতের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জয় পায় বাংলাদেশ। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত খেলায় ভারতের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি গোল ঠেকিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার মূল কারিগর ইয়ারজান বেগম। তার গ্রামে বইছে আনন্দের বন্যা। ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টের রোগী। চলাফেরা করতে পারলেও কাজ করতে পারেন না। মা রেনু বেগম অন্যের বাড়ি এবং খেতখামারে দুইশ থেকে আড়াইশ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। সেই আয় দিয়েই দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার চলে টেনেটুনে। হতদরিদ্র ঘরের সন্তান ইয়ারজান বেগম। দুই বেলা খাবার জুটত না সাফ ফুটবল তারকার। সোমবার সকালে ইয়ারজানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার আত্মীয়স্বজন ছাড়াও এলাকার লোকজনের ভিড়। জেলা শহরে থেকেও অনেকে দেখতে যান ইয়ারজানের বাড়ি। ভাঙাচোরা ঝুপড়ি ঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন ইয়ারজান বেগম। বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে বাইরে থেকে দেখা ঘরের ভিতরের হতদরিদ্রের প্রতিচ্ছবি। দরিদ্রতার জন্যেই খুশির এমন মুহূর্তেও ইয়ারজানের বাবার কাছে নেই মিষ্টি কেনার টাকা। তাই প্রতিবেশীরা নিজেদের টাকায় মিষ্টি কিনে মানুষজনদের মিষ্টিমুখ করান। এ সময় ইয়ারজানের স্কুলের শিক্ষকরাও তার বাড়িতে যান। ক্ষুদে এই ফুটবল কন্যার সাফল্যের খবরে তার ভাঙা বাড়িতে দর্শনার্থী উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ইয়ারজান বেগমের এই জয়ের পর থেকেই দেশের ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে আনন্দে ভাসছে ইয়ারজানের পরিবারসহ এলাকার মানুষ। রোববার রাতেই ইয়ারজানের বাড়িতে ভিড় শুরু করে স্থানীয় বিভিন্ন বয়সি মানুষ। এদের অনেকেই নিজের টাকায় মিষ্টি কিনে একে অন্যের মুখে মিষ্টি তুলে দেন। সাফ ফুটবল জয়িতা ইয়ারজানের বাড়ি পঞ্চগড় উপজেলা সদরের হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। অভাবের সংসারে দুই বেলা ঠিকমত খাবার জুটত না ইয়ারজানের। এর মধ্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলায় ভালো করে সে। স্কুলের হয়ে জেলা পর্যায়ে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয় ইয়ারজানের ফুটবল দল। জেলাপর্যায়ে বিভিন্ন খেলার সময় ইয়ারজানের প্রতিভা আন্দাজ করেন পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান। এরপর পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে টুকু ফুটবল একাডেমি থেকে তাকে প্রশিক্ষিত করা হয়। তবে সংসারে দারিদ্র্যতার কারণে প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরের মাঠে প্রশিক্ষণে যাওয়ার রিকশা ভাড়াও দিতে পারতেন না ইয়ারজানের বাবা-মা। খাবার জোগানই সেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে খেলার জন্য টাকা খরচ করা ইয়ারজানের পরিবারে যেন চিন্তার বাইরে। একে তো গরিব ঘরের প্রত্যন্ত এলাকার মেয়ে। তার ওপর আবার ফুটবল খেলা। ইয়ারজানের ফুটবল খেলা মেনে নিতে পারেননি এলাকার মুরুব্বিরা। এতে সমর্থন দেয় ইয়ারজানের বাবা-মা। তারা ইয়ারজানকে খেলাধুলা করতে বাধা দেন। তবে বাবা-মাকে বুঝিয়ে এবং লোকলজ্জা পেছনে ফেলে এগিয়ে যান ইয়ারজান। জেলা পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার বিভিন্ন লিগ এবং ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি। সর্বশেষ সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে দেশের হয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার খবরে এখন যেন ইয়ারজান শুধু হাড়িভাসা আর খোপড়াবান্দি নয়, পঞ্চগড়সহ দেশের গর্ব হয়ে উঠে সে। ইয়ারজানের মা রেনু বেগম বলেন, খেলার জন্য আমার মেয়ে ইয়ারজানকে মারপিট করেছি, অনেক বকাবকি করতাম, ভয় দেখাতাম। খেলতে যেতে নিষেধ করতাম। কিন্তু সে লুকিয়ে চলে যেত খেলতে। পরে যখন বুঝলাম সে ভালো খেলছে, তখন আর গালি দিতাম না। তবে খেলতে যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়াও দিতে পারতাম না। ওর বাবা অসুস্থ, কাজ করতে পারেন না। আমার আড়াইশ টাকা মজুরির আয় দিয়ে দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার চলত। তাকে কখনো ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। অনেক সময় সে না খেয়েই খেলতে চলে যেত। এখন সে বিদেশের মাটিতে খেলে ভালো করেছে। আমরা খুব খুশি হয়েছি। আমাদের মতো এলাকার সবাই খুশি হয়েছে। ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি দুইবার টিবির চিকিৎসা নিয়েছি। এখনো কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্বাসকষ্ট হয়। কোন কাজ করতে পারি না। ইয়ারজানের মায়ের সামান্য আয় দিয়েই আমাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। মেয়েকে ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। কোনো কোনো দিন আমার মেয়ে সকালে নাস্তা করে সেই নাস্তা দিয়েই সারা দিন কাটিয়েছে। দুপুর এবং রাতে ভাত পায়নি, কারণ আমি খাবার জোগাড় করতে পারি নাই। এজন্য আমি আমার মেয়েকে খেলা বাদ দিতে বলেছিলাম। টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, হাড়িভাসার মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ইয়ারজান নিয়মিত শহরে এসে প্রশিক্ষণ নিত। তার এই ফুটবল খেলা গ্রামের অনেকেই ভালো চোখে দেখত না। এর মাঝেও প্রতিদিন সে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে মাঠে হাজির হয়ে আমাকে ফোন করে আসতে বলত। তার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে অবাক হতাম। তার অনেক বড় স্বপ্ন। এখন সে স্বপ্নে অনেক কাছাকাছি। আশা করি সে আগামীতে জাতীয় দলের হয়ে খেলবে।