কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। দিন-রাত, বাসা-অফিস, হাট-বাজার, স্কুল ও জনসমাগমস্থল কোথাও মশার হাত থেকে নিস্তার মিলছে না। যদিও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দাবি- তাদের তৎপরতায় মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বছরের শুরুতে তারা কিউলেক্স মশা প্রজননের ভয়াবহ রূপ ধারণের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন তা আমলে নেয়নি। উপরন্তু তারা বলেছে, বিশেষজ্ঞরা তাদের ভালো কাজগুলো দেখতে পায় না। এখন মশার ভয়াল উপদ্রব চললেও তাতে তারা কান দিচ্ছেন না। ভুক্তভোগীরা জানান, মশার উপদ্রবে তারা অতিষ্ঠ। কিউলেক্স মশার ভয়াবহ উপদ্রবের সময়েও সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে না। সকালে ড্রেনগুলোয় লার্ভা নিধনের ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও তা দেখা যায় না। বিকালে ফগিং করার নিয়ম থাকলেও মশক কর্মীদের দেখা মিলছে না। অভিজাত এলাকা ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মশক কর্মীদের তৎপরতা থাকলেও অন্য এলাকায় তাদের দেখা মিলছে না। তারা আরও জানান, রাত-দিন সব সময়ই মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ থাকতে হচ্ছে। কয়েল জ্বালিয়ে মশারি টাঙিয়েও নিস্তার মিলছে না। একটু বেখেয়াল হলেই মশার হামলার শিকার হচ্ছে শিশুরা। তাদের শরীরে গোটা গোটা হয়ে যাচ্ছে। রমজানে স্কুল খোলা থাকায় শিশুরা স্কুলে গিয়েও মশার কামড় খাচ্ছে। মেয়ররা মশা দমনের নানা গল্প শোনালেও বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ মিলছে না। দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা মো. আমিরুল আলম বলেন, বিগত ২ থেকে ৩ মাসে দক্ষিণ বনশ্রী এলাকায় মশক কর্মীদের দেখা মেলেনি। সকাল ও বিকালে দুই ধরনের ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও এক ধরনের ওষধুও সিটি করপোরেশনের কর্মীরা ছিটাচ্ছেন না। অথচ হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ বছরে মোটা অঙ্কের স্বাস্থ্য কর আদায় করছে। মশা নিয়ন্ত্রণের নামে বরাদ্দও করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। কুড়িল এলাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আব্দুল হান্নান বলেন, কিউলেক্স মশা ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে। চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাওয়ার মতো ফুরসত নেই। নামাজ, ইফতার, অফিসে কাজের সময় কিউলেক্স মশার উপদ্রবে নাকাল হতে হচ্ছে। কিন্তু এই এলাকায় মশক কর্মীদের কোনো পদচারণা লক্ষ্য করা যায় না। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, দেশে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। ঢাকায় ১৬ প্রজাতির মশা বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে কিউলেক্স মশা প্রায় ৯০ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া এবং অন্যান্য মশা। তবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কিউলেক্সের পরিমাণ বেশি থাকে। এই সময় কিউলেক্স ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ হয়ে যায়। এখন ঢাকার ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা। কীটতত্ত্ববিদ ও মশাবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বছরজুড়ে তিনি মশার প্রজনন নিয়ে গবেষণা করেন। এজন্য তিনি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশা ধরার ফাঁদ পেতেছেন। প্রতি মাসে তিনি মশার প্রজননের চিত্র বিশ্লেষণ করেন। ডিসেম্বরে তার পর্যবেক্ষণ বলছে, অক্টোবরের শুরুতে সপ্তাহে গড়ে ২০০টি মশা ধরা পড়ত। নভেম্বরে গড় সংখ্যা একই রকম ছিল। তবে ডিসেম্বরে সপ্তাহে ফাঁদগুলোতে মশা ধরা পড়ার গড় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০টি। আর জানুয়ারিতে ফাঁদগুলোতে মশা ধরা পড়ার গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০টি। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তা বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায় বা ৪৫০টিতেতে পৌঁছেছে। কোথায় জন্মায় কিউলেক্স : দূষিত ও বদ্ধ জলাশয়গুলো মূলত ঢাকার কিউলেক্স প্রজননের প্রধান উৎস স্থল। ঢাকায় সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার বদ্ধ নর্দমা, খাল, ডোবা ও নদী। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর দূষিত পানিতে বিপুল পরিমাণ কিউলেক্স মশার প্রজনন ঘটছে এমন তথ্য কীটতত্ত্ববিদদের। কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী জানান- সিটি করপোরেশন কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। যখন যে কাজ করা দরকার, সেটা করে না। যেভাবে করা দরকার, সেভাবে করে না। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মানুষকে জেল-জরিমানা করে হয়রানি করে থাকে। তিনি বলেন, কিউলেক্স মশার ৯৫ ভাগ প্রজনন উৎস ডোবা, নালা ও জলাশয়। এসবের বেশিরভাগের মালিকানা সরকারি সংস্থার। সিটি করপোরেশনকে নেতৃত্ব দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। সিটি করপোরেশনকে অনেক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তারা কোনো কিছু শোনে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান জানান- ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণ কাজ সঠিক নিয়মে চলছে না। এটা বারবার বলা হলেও তারা মানতে নারাজ। নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো কাজ করছে। এতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অভিমত : জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল রূবাইয়াত ইসমত অভীক বলেন, এখন কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম চলছে। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় কিউলেক্স মশা বেড়েছে। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির বলেন, এখন কিউলেক্স মশার প্রজননের ‘পিক টাইম।’ এজন্য কিছুটা কিউলেক্স মশার দেখা মিলছে। অন্যান্য বছর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তার তুলনায় অনেক কম মশার প্রজনন ঘটছে।