তীব্র সংকটের মধ্যেই আগামী মৌসুমে যাত্রীদের হজব্রত পালনের জন্য সরকারকে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলারের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকা। আগামী এপ্রিল ও মে এই দুই মাসের মধ্যেই প্রচলিত ব্যয়ের অতিরিক্ত হিসাবে ওই পরিমাণের ডলারের জোগান লাগবে। এর মধ্যে ব্যাংক ও হজযাত্রীরা আগ্রহী হলে ৭৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সৌদি রিয়াল ব্যবহার করা যাবে। ডলার লাগবে ২৩ কোটি। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। বাড়বে রিয়ালের ব্যবহার। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, হজের বিষয়টি তারা বিবেচনায় নিয়ে ডলারের জোগান নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেছে। এ খাতে প্রয়োজনে রিজার্ভ থেকেও ডলার দেওয়া হবে। অনেক ব্যাংককেই রিয়াল আছে। ফলে রিয়ালও হজ যাত্রীরা নিতে পারবেন। ফরেন ড্রাফট আকারেও পর্যাপ্ত রিয়াল দেওয়া যাবে। আগামী এপ্রিল মে মাসেই হজের ডলার প্রয়োজন হবে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৩২৬৭ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মতে, আগামী মাসে রিজার্ভ নিট হিসাবে ২২৯৪ কোটি ডলারে নেমে আসবে। ওই সময়ে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দেনা বাবদও প্রায় ১৩০ থেকে ১৪০ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। এর সঙ্গে হজের জন্য ১০০ কোটি ডলার। সব মিলে তখন রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে। সূত্র জানায়, আগামী হজের জন্য সরকার ইতোমধ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর আলোকে বেসরকারি হজ অপারেটর সংস্থাগুলোর সংগঠন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজের আওতায় সরকারি বেসরকারি মিলে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালনের সুযোগ পাবেন। সব প্যাকেজেই এবার বিমান ভাড়া বাবদ ধরা হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ডলারের হিসাবে এক হাজার ৮০০ ডলার। এ হিসাবে বিমান ভাড়া বাবদ লাগবে প্রায় ২৩ কোটি ডলার। হজযাত্রীদের অর্ধেক পরিবহণ করবে বাংলাদেশ বিমান। বাকি অর্ধেক আন্তর্জাতিক অন্যান্য বিমান সংস্থা পরিবহণ করবে। বিমান যে যাত্রী পরিবহণ করবে তাদের কাছ থেকে ভাড়া বাবদ যে আয় হবে তার ৩০ শতাংশ খরচ হবে স্থানীয় মুদ্রায়। বাকি অর্থ খরচ হবে ডলার এবং রিয়ালে। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল, সৌদি আরবে বিমানবন্দরের ফি পরিশোধ ও বিমান কর্মীদের থাকা খাওয়ার খরচ। এ ক্ষেত্রে বিমান রিয়ালের মাধ্যমে সৌদি আরবের খরচ মেটানোর সুযোগ পেলেও তারা তা ডলারেই পরিশোধ করে। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে ডলারেই তা পরিশোধ করা হয়। তবে কারেন্সি বেনিফিট বা মুদ্রার সুবিধা পেতে স্থানীয় মুদ্রাও ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিমান সৌদি বিমানবন্দরের ফি ও কর্মীদের থাকা খাওয়ার খরচ রিয়ালে মেটাতে পারে। গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ২১ টাকা বা ২৫ শতাংশ। সৌদি রিয়ালের দাম বেড়েছে পাঁচ টাকা বা ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এ হিসাবে ডলার চেয়ে রিয়াল খরচ করলে ব্যয় প্রায় ৫ শতাংশ কমবে। এ প্রসঙ্গে হাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইয়াকুব শরাফতী বলেন, চলতি মৌসুমে হজযাত্রীদের অর্ধেক পরিবহণ করবে বিদেশি বিমান সংস্থা। সেহেতু তাদের ব্যয় ডলারে পরিশোধ করতে হয়। বিমানের কিছু ব্যয় রিয়ালে পরিশোধ করা সম্ভব। এতে খরচ কিছু কমবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত রিয়াল নেই। যে জন্য তারা রিয়াল দিতে চায় না। যাত্রীরাও ডলার নিতে চায়। কারণ সৌদি আরব থেকে অন্য দেশে গেলে ডলার কাজে লাগে। হজ বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের ডলার প্রয়োজন হবে। অতিরিক্ত বিমান ভাড়া নির্ধারণের কারণে এবার অনেক বৈদশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাবে। সূত্র জানায়, হজযাত্রীদের বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, খাওয়া দাওয়া ও গাউড ফি বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা। এ অর্থের পুরোটাই খরচ হবে সৌদি আরবে। ফলে এ অর্থও রিয়ালে খরচ করার সুযোগ রয়েছে। এ খাতের খরচের জন্য সৌদি মুদ্রা নিলে জনপ্রতি লাগবে ১৬ হাজার ৭৪২ রিয়াল। মোট লাগবে ২১৩ কোটি রিয়াল। যা ৫৭ কোটি ডলারের সমান। এতেও ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ শতাংশ কমলেও ডলারের বিপরীতে সৌদি মুদ্রা রিয়ালের দাম কমেনি। বরং রিয়ালের বিপরীতে ডলার দুর্বল হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে রিয়াল। এদিকে টাকার বিপরীতেও ডলারের দাম বেশি বেড়েছে, সে তুলনায় রিয়ালের দাম বেড়েছে কম। এ ছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৩ দশমিক ৭৬ রিয়াল। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ডলারের দাম সামান্য কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৭৪ রিয়াল। অর্থাৎ সৌদি মুদ্রার মান কিছুটা বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় বাংলাদেশে পণ্যের দাম বেড়েছে, কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। অন্যদিকে সৌদি আরবে ডলারের বিপরীতে রিয়ালের মান বাড়ায় পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে, এতে বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। একই সঙ্গে সৌদি আরবে হাজিদের খরচও কমবে। কেননা সৌদি আরবে হাজিরা সব খরচই করবেন রিয়ালে। ব্যবহার করবেন বেশির ভাগই আমদানি করা পণ্য। তাদের দেশে ডলারের দাম না বাড়ায় পণ্যের দামও বাড়েনি। ফলে রিয়ালের হিসাবে খরচ বাড়ার কথা নয়। কিন্তু টাকার বিপরীতে রিয়ালের দাম বাড়ায় টাকায় খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। তার পরও ডলারের তুলনায় খরচ বাড়বে কম। এছাড়া সৌদি আরবে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন। ফলে রেমিট্যান্স হিসাবে রিয়াল পাওয়া খুব সহজ। এ প্রক্রিয়ায় রিয়াল সংগ্রহ করে হজযাত্রীদের জন্য রিয়ালে প্যাকেজ ঘোষণা করলে এবং ব্যাংকগুলো থেকে রিয়াল ইস্যু করলে খরচ বেশ কমবে। ডলারের তুলনায় যেহেতু রিয়ালের দাম ৫ শতাংশ কম বেড়েছে সে হিসাবে এ খাতে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা কমবে। হজের সর্বনিম্ন প্যাকেজের আওতায় বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ওই সাশ্রয় হয়। এর বাইরেও আরও অনেক বিলাসী প্যাকেজ রয়েছে সেগুলোতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় হবে। এ ছাড়া কোরবানি, ব্যক্তিগত কেনাকাটার টাকা এর বাইরে রয়েছে। ফলে প্যাকেজে অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে। গত বছরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী হজযাত্রীরা প্যাকেজের অতিরিক্ত আরও এক হাজার ২০০ ডলার বা এর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। প্রতি যাত্রী ওই পরিমাণে ডলার নিলে এ খাতে লাগবে প্রায় ১৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার। প্রায় সব যাত্রীই ওই হারে ডলার নিয়ে থাকেন। কেননা হজযাত্রীদের কাছে ডলার কেনার টাকা না থাকলে এসেন্সিগুলো টাকা দিয়ে ডলার নিয়ে তারা নিজেরা বড় প্যাকেজের ক্ষেত্রে খরচ করে। এ ক্ষেত্রে সৌদি মুদ্রা নিলে লাগবে ৫৭ কোটি রিয়াল। ফলে এ খাতেও ডলারের পরিবর্তে রিয়াল নিলে সাশ্রয় মিলবে প্রায় জনপ্রতি ছয় হাজার ৭০০ টাকা। ফলে দুই খাতে সাশ্রয় হবে ৩৩ থেকে ৩৪ হাজার টাকা। সূত্র জানায়, সর্বনিম্ন প্যাকেজে বিমান ভাড়া, হজের খরচ ও ব্যক্তিগত খরচ মিলে হজ এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রীর জন্য খরচ হবে প্রায় ৯৫ কোটি ডলার। বিলাসী প্যাকেজে খরচ আরও বাড়বে। এ কারণে খরচ ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছবে। এদিকে বর্তমানে অফিসিয়াল চ্যানেলে ডলারের দাম ১০৭ টাকা। কিন্তু ব্যাংকে ১১০ টাকার কম ডলার মিলছে না। সরকার থেকেও ১১০ টাকা প্রতি ডলারের দাম ধরে প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এপ্রিল মে মাসে ডলারের দাম আরও বাড়বে। ফলে খরচও বেড়ে যাবে।