ডলার সংকটে চরম বিপর্যয়ের মুখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি আমদানি। ফলে গ্যাস, কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী গরমে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে দেশ। গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় ইতোমধ্যে ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের শিল্প খাত। আগামী মার্চ থেকে গরম পড়লে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে। তখন লোডশেডিং বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী জুনের মধ্যে ডলার সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। এমন কী চলতি বছরের শেষ পর্যন্তও এ সংকট থাকতে পারে। আর তাতে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানি বাধার মুখে পড়বে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শিল্পের চাকা সচল ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সব ধরনের জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার সংস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। সে মোতাবেক ইতোমধ্যে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী মাসের মধ্যে এলএনজি ঢাকায় পৌঁছার কথা রয়েছে। সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম গত এক বছরের তুলনায় এখনো প্রায় দ্বিগুণের বেশি। যদিও গত জুলাইয়ের তুলনায় দাম কিছুটা কমেছে। আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। মূলত ডলার সংকটের কারণে দাম বেড়েছে। গত এক বছরে ডলারের দাম ২১ টাকা বৃদ্ধিতে জ্বালানি আমদানির খরচও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগেরই জ্বালানি হচ্ছে গ্যাস, কয়লা ও তেল। শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোও পরিচালনা করা হয় গ্যাস ও তেল দিয়ে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ও তেল অপরিহার্য কাঁচামাল। গ্যাসের বড় অংশ দেশ থেকে জোগান দেওয়া হয়। কিছু আমদানি করা হয়। কিন্তু জ্বালানি তেলের পুরোটাই চলছে আমদানির মাধ্যমে। কয়লারও বেশির ভাগ আমদানি করা হয়। আর এসব আমদানির এলসি খুলতে প্রয়োজন হয় ডলার। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে গত কয়েক মাস ধরে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই ডিসেম্বরে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি ৩৬ শতাংশ ও আমদানি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে পরিশোধিত তেল আমদানির এলসি ৭৬ শতাংশ ও আমদানি বেড়েছে ১০৪ শতাংশ। এসব তেল পরিবহণ ও কৃষি খাতে ব্যবহৃত হয়। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বড় অংশই ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম কাঁচামাল জ্বালানি তেল আমদানির এলসি গত জুলাই ডিসেম্বরে কমেছে ৪৪ শতাংশ এবং আমদানিও কমেছে ৫৩ শতাংশ। ফলে আগামী কয়েক মাসে আমদানি আরও কমবে। এদিকে গত এক বছরের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৫৫ ডলার। গত জুলাইয়ে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৭ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ৭৮ ডলারে নেমেছে। এক বছরের তুলনায় দাম এখনো বেশি। এদিকে ডলার সংকট ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকলে গত আগস্টে সরকার জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ গুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে কিছু কেন্দ খোলা হলেও জ্বালানির অভাবে সেগুলো বন্ধ রয়েছে। জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থায়নে। তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তেল আমদানির পর বিক্রি করে ওইসব অর্থ পরিশোধ করা হয়। তেল বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ঋণ পরিশোধের জন্য টাকা ব্যাংকে জমা দিলেও ডলারের অভাবে পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এতে ঋণের বেশ কয়েকটি কিস্তি আটকে গেছে। বকেয়া পড়েছে ১৪০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২২ কোটি ডলার বা ১৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যদিও এ মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু জানা গেছে কিছু কিস্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও বেশির ভাগ এখনো আলোচনার টেবিলে। জানা গেছে, বর্তমানে কয়লা আমদানির এলসি খোলা ও আমদানি দুটোই কমেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামও বেড়েছে। ফলে পরিমাণগত হিসাবে কয়লার আমদানি অনেক কম। গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ চালু হয়। তখন থেকে কয়লার চাহিদা বাড়লেও ডলার সংকটে আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ৪১ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের কয়লা আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। কিন্তু আমদানি করা হয় মাত্র ২৮ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। একইভাবে গত অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৪৫ কোটি ডলারের। কিন্তু আমদানি হয় ৩০ কোটি ডলারের। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ে এলসি কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৪ শতাংশ। জানুয়ারির মধ্যভাগে কয়লা সংকটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এখান থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা ছিল। এটি বন্ধ থাকায় ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি রামপালের একটি ইউনিটের উৎপাদন চালু হয়। দ্বিতীয় ইউনিটটি এখনো চালু হয়নি। জানা গেছে, আগামী জুনের মধ্যে চালুর কথা থাকলেও কয়লা সংকটে সেই সম্ভাবনাও নেই। সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সহসা ডলার সংকট কাটছে না। এতে কয়লা আমদানি বাড়ানোও কঠিন হবে। কেননা ইতোমধ্যে আমদানি করা কয়লার দেনা এখনো শোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কয়লা সরবরাহ করতে গড়িমসি করছে। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির দেনার মধ্যে গত জুনে ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে তা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। গত জানুয়ারিতে ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়। এ অবস্থায় এখন নতুন এলসি খোলার সুযোগ মিলেছে। এ ছাড়া আরও একটি সংস্থার কাছে সাত কোটি ৪০ লাখ ডলারের কয়লা আমদানি দেনা বকেয়া ছিল। এর মধ্যে চার কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি অর্থ পরে পরিশোধ করা হবে। এই শর্তে কয়লা আমদানির জন্য সম্প্রতি এলসি খোলা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে এসব কয়লা আসবে। চলতি মাসের শেষ দিকে কয়লা দেশে আসার কথা রয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম। বিদ্যুৎকেন্দে র জন্য গ্যাস আমদানি গত সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দামও বেশি। ফলে গ্যাস আমদানিও কমে গেছে। এদিকে সরকারের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই জ্বালানি খাতের। সরকারি সংস্থাগুলোর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৫৮ কোটি ডলার, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৬৩৩ কোটি ডলার। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৩৪ কোটি ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেই। এসব ঋণের বড় অংশই জ্বালানি খাতের। ডলার সংকটের কারণে এখন এসব ঋণ পরিশোধও বিলম্বিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হলে এলসি খোলা আরও বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়নের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রাউজানে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ রয়েছে। প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ২১০ মেগাওয়াট। এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। গ্যাস সংকটের কারণে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই বন্ধ রয়েছে। ১৫০ মেগাওয়াটের শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে গ্যাস সংকটের কারণে। কয়লা সংকটে বড় পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দে ও উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাস ও তেলভিত্তিক কেন্দে র মধ্যে আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল, শিকলবাহা, সিদ্ধিরগঞ্জ কেন্দে র উৎপাদন কমেছে। জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে ২৪ মেগাওয়াটের রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ১০০ মেগাওয়াটের এনার্জি প্যাক পাওয়ার প্ল্যান্টও বন্ধ রয়েছে। কাপ্তাই লেকে এবার পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এ কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দে র পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে চারটিই বন্ধ। একটি ইউনিট সচল রয়েছে। এর আগে একটি ইউনিট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। বর্তমানে ইউনিটটি সংস্কার করে সচল করা হয়েছে। তবে পানি স্বল্পতার কারণে উৎপাদন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।