রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় ১ ফেব্রুয়ারি রাতে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটেছে। ক/২১১/২ বি নম্বর বাড়ির গ্যারেজ ভেঙে ভেতর থেকে দুটি মোটরসাইকেল চুরি করে দুর্বৃত্তরা। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাত ২টা ৪০ মিনিটে তিন ব্যক্তি গেট ভেঙে গ্যারেজে ঢোকে। এর পর গ্যারেজে রাখা সাতটি মোটরসাইকেলের মধ্যে দুটির তালা ভেঙে তারা দ্রুত পালায়। একইভাবে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমলেও বাড়ছে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। অপরাধ মোকাবিলায় বাহিনীতে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ডিএমপি। যে কোনো সদস্যের প্রতিবছর ৬০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অপরাধ বিশ্নেষকরা বলছেন, একটি শহরের পরিসংখ্যান দিয়ে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিরূপণ করা যায়। ডিএমপির গত ৯ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে ঢাকায় ৫০টি থানায় মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। এই হিসাবে মাসে গড়ে মামলা হচ্ছে ২ হাজার ৩৯৫টি। ২০২১ সালে মামলা হয় ২৭ হাজার ৪৬১টি। আর ২০২০ সালে ২২ হাজার ৬৭৩টি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায়ও ঢাকার চুরি ও ছিনতাই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের আরও সজাগ থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্নেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তা পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ, ধর্ষণ বা ছিনতাইয়ের মতো অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় যেতে চান না। আবার অনেক সময় পুলিশও মামলা নিতে চায় না। ফলে অনেক ঘটনা হিসাবের বাইরে থেকে যায়। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এখানে নানা ধরনের অপরাধ হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে চেষ্টা আছে, সাফল্যও আছে। কিন্তু চুরি, ছিনতাই ও ধর্ষণের মতো অপরাধ যদি বেড়ে যায়, তাহলে বোঝা যায়, নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। অথচ পুলিশের প্রধান দায়িত্ব মানুষ ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ডিএমপির ৪৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস আজ। পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বর্তমানে ডিএমপিতে ৫৭টি বিভাগ, ৫০টি থানা রয়েছে। সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার। ডিএমপির প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে ডিএমপি সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ হওয়ার পর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা ও মানুষের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে এবং পুলিশ সেবার মান আরও উন্নত করতে ডিএমপিকে আরও বেশি জনসম্পৃক্ত হতে হবে। জনগণের বন্ধু হয়ে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মেগাসিটি বৈচিত্র্যময় মহানগরী ঢাকার সার্বিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে বিনিয়োগবান্ধব স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপির বিশেষ অবদান রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রচলিত অপরাধের পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ বাড়ছে। তাই স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট গঠন জরুরি। বর্তমানে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পাশাপাশি ডিবির সাইবার ইউনিট আলাদাভাবে কাজ করছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগরে পুলিশের নথিভুক্ত ডাকাতির মামলা ছিল ৪৭টি, দস্যুতা ২৬৫, খুন ২৬২, দ্রুত বিচার আইনে ৩৩২, দাঙ্গা ৭, ধর্ষণ ২৭৮, শিশু নির্যাতন ১৭৩, নারী নির্যাতন ১ হাজার ১৬৪, অপহরণ ১৭৬, পুলিশ আক্রান্ত ১০৪, বাসায় চুরি ৬৫০, গাড়ি চুরি ৮৮২, তার চুরি ১৩, গরু চুরি ৮, অন্যান্য চুরি ১ হাজার ২২৭। সব মিলিয়ে অপরাধ-সংক্রান্ত মামলা ছিল ৫ হাজার ৫৮৪ ও অন্যান্য মামলা ৬ হাজার ২১৯। এ ছাড়া অস্ত্র, মাদক, বিস্ম্ফোরক ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধারের মামলা ৭ হাজার ৬১৪টি। বছরে মোট মামলার সংখ্যা ১৯ হাজার ৪১৭টি। ২০১৫ সালে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন কিছুটা কম ছিল। তবে বেড়ে যায় ধর্ষণ। অপরাধ খাতে মামলা ৪ হাজার ৯০৮ ও অন্যান্য উদ্ধারজনিত মামলা ৫ হাজার ৭৯৫। ২০১৬ সালে ডাকাতি, দস্যুতা ও খুন কমে আসে। তবে ধর্ষণের ঘটনা আরও বেড়ে যায়। এ বছরে ডাকাতির মামলা ২৩, দস্যুতা ১৩২, খুন ১৬৫, দ্রুত বিচার আইনে ২১৭, দাঙ্গা ২, ধর্ষণ ৩২৫, এসিড নিক্ষেপ ৫, নারী নির্যাতন ১ হাজার ১৪১, শিশু নির্যাতন ১৮০, অপহরণ ১০৩, পুলিশ আক্রান্ত ৭০, বাসায় চুরি ৫৫৯, গাড়ি চুরি ৫৬৭, তার চুরি ১২, গরু চুরি ৯, অন্যান্য চুরি ৯৫৬। এ বছর অপরাধ খাতে মামলা ৪ হাজার ৪৬৬ এবং অন্যান্য মামলা ৫ হাজার ৩৬৩টি। এ ছাড়া অস্ত্র, বিস্ম্ফোরক, মাদক ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধারের ঘটনায় ১০ হাজার ৭১টি মামলা হয়। বছরে মোট মামলার সংখ্যা ১৯ হাজার ৯০০টি। ২০১৭ সালে ডাকাতি-দস্যুতা কিছুটা কমলেও বেড়ে যায় খুন ও ধর্ষণ। ২০১৮ সালে ডাকাতি-দস্যুতা-খুন আরও কিছুটা কমে আসে। তবে ধর্ষণ আরও বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে এসে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, ধর্ষণ সবই বেড়ে যায়। ওই বছর মোট মামলা ছিল ২৭ হাজার ৯৩৪টি। ২০২০ সালে আগের বছরগুলোর মতোই ধর্ষণ ও চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার ধারা অব্যাহত ছিল। এ বছর ডাকাতির মামলা ২১, দস্যুতা ১৭৬, খুন ২১৯, দ্রুত বিচার আইনে ১০৫, দাঙ্গা ৩, ধর্ষণ ৫৬৯, এসিড নিক্ষেপ ৩, নারী নির্যাতন ১ হাজার ২০০, শিশু নির্যাতন ৪২৬, অপহরণ ৪৪, পুলিশ আক্রান্ত ৫৪, বাসায় চুরি ৬৫৮, গাড়ি চুরি ৩৩২, তার চুরি ৫, গরু চুরি ৬ এবং অন্যান্য চুরি ৮৭৪টি। অপরাধ খাতে মামলা ৪ হাজার ১১৫ এবং অন্যান্য মামলা ৫ হাজার ১৩২টি। এ ছাড়া অস্ত্র, বিস্ম্ফোরক, মাদক ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধারের মামলা ১২ হাজার ৮৪৬টি। বছরে মোট মামলা ২২ হাজার ৬৭৩টি। ২০২১ সালে ডাকাতির মামলা ২৩, দস্যুতা ১৪৫, খুন ১৬৬, দ্রুত বিচার আইনে ৮৮, দাঙ্গা ৪, ধর্ষণ ৫৪৬, নারী নির্যাতন ১ হাজার ২৬২, শিশু নির্যাতন ৪২০, অপহরণ ৪৯, পুলিশ আক্রান্ত ৬৯, বাসায় চুরি ৬৪৩, গাড়ি চুরি ৩৪০, তার চুরি ১৩, গরু চুরি ৪, অন্যান্য চুরি ৯৮৬টি। অপরাধ খাতে মামলা ৪ হাজার ৭৪৮, অন্যান্য মামলা ৬ হাজার ১৩৯টি। এ ছাড়া অস্ত্র, বিস্ম্ফোরক, মাদক ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধারের ঘটনায় মামলা ১৬ হাজার ৫৭৪টি। বছরে মোট মামলা ২৭ হাজার ৪৬১টি। ২০২২ সালে সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ চুরির ঘটনা ঘটে। এ বছর ডাকাতির মামলা ২৭, দস্যুতা ১৪৫, খুন ১৭৩, দ্রুত বিচার আইনে ১৬৫, দাঙ্গা ৮, ধর্ষণ ৪৯৭, এসিড নিক্ষেপ ২, নারী নির্যাতন ১ হাজার ১০৮, শিশু নির্যাতন ৪০৫, অপহরণ ৪৯, পুলিশ আক্রান্ত ৮৮, বাসায় চুরি ৭১৩, গাড়ি চুরি ৩৮৭, তার চুরি ১৭, গরু চুরি ৬, অন্যান্য চুরি ১ হাজার ১৯৩টি। এ বছর অপরাধ খাতে মামলা ৪ হাজার ৯৮৩ এবং অন্যান্য মামলা ৭ হাজার ৩৬৬টি। এ ছাড়া অস্ত্র, বিস্ম্ফোরক, মাদক ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধারের ঘটনায় মামলা সংখ্যা ১৬ হাজার ৪০০টি। বছরে মোট মামলা ২৮ হাজার ৭৪৯টি।