অগ্নিঝরা মার্চের ২৩তম দিন আজ। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ উত্তাল ছিল সারা দেশ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। দিনটি ছিল পাকিস্তান দিবস। কিন্তু ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়েনি। অন্যদিকে ঢাকা পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকায় ছেয়ে যায় চারদিক। সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট, ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর, বেতার-টেলিভিশন ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, প্রধান বিচারপতি ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে তোলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ একের পর এক পতাকাশোভিত ঝাঁজাল মিছিল যায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের বাড়িতে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের সামরিক কায়দায় অভিবাদনের মধ্য দিয়ে এদিন সূর্যোদয়ের সময় বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে নিজ হাতে পতাকা উত্তোলন করেন। এসময় সেখানে সম্মিলিত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি গাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু বারবার হাত নেড়ে মিছিলকারীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শিশু রাসেল বসেছিল পিতার কাছেই। দোতালার বারান্দায় রেলিংটার ওপর ভর দিয়ে গণআবেগের উদ্দাম দৃশ্য অবলোকন করছিলেন বেগম মুজিব ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। এদিন জয় বাংলা বাহিনীর পাঁচ শতাধিক সদস্য প্যারেড করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তারা সেখানে অভিবাদন জানান। বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ শেষে জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি বলেন, বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই আপনারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেন। বাংলার জয় অনিবার্য। বিকালে পশ্চিম পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রধান, জমিয়তে ওলামায়ের প্রধান, পাঞ্জাব কাউন্সিল লীগের প্রধান ও বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়ে যাক। এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা ভালো কামনা করুন, কিন্তু খারাপের জন্যও প্রস্তুত থাকুন। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে পালন করে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সাবেক বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। কুচকাওয়াজ ও মহড়ার শুরুতে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এবং সামরিক কায়দায় অভিবাদনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। এ সময় রেকর্ডে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাজানো হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দিলে ছাত্র-জনতা তা উপেক্ষা করে পতাকা তোলেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে জিন্নাহর ছবি এবং ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করে প্রতিবাদী জনতা। ঢাকায় টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা এদিন অভূতপূর্ব এক কাজ করেন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এদিন মধ্যরাত পেরিয়ে আরও ৯ মিনিট চলে। বাজেনি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। পর্দায় পাকিস্তানের পতাকাও উড়েনি।