নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ এসে পৌঁছেনি। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা নতুন করে বাড়ালেও ভারত প্রতিশ্রুত পেঁয়াজ দেবে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালেও কোনো কোনো দেশকে তারা কিছু পণ্য সরবরাহ করে থাকে বিশেষ বিবেচনায়। চাল-গমসহ ছয়/সাতটি পণ্যে আমরা ভারতের ‘কোটা’ চেয়ে আসছি। প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী। সেটা অব্যাহত রাখা হয়েছে প্রয়োজনেই। নিজ বাজার শান্ত রাখতে ভারত এখন যেসব পণ্য রপ্তানি করতে চাইছে না, সেগুলোর কিছু আবার আমাদের আনা প্রয়োজন। ভারত থেকে আমদানিটা আবার নানা দিক দিয়ে সুবিধাজনক। সবচেয়ে বড় সুবিধা সময় ও পরিবহণ ব্যয় কম লাগা। আমদানিতে আমাদের প্রথম পছন্দ তাই ভারতীয় বাজার। সেখান থেকে কিছু আলু আমদানি হওয়ার খবরও রয়েছে। আর আসার কথা পেঁয়াজ। সরকার সম্ভবত ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ চেয়েছিল। এমন খবরও দেখেছিলাম, ভারত দিতে রাজি ২০ হাজার টন। তবে প্রতিমন্ত্রীর কথায় মনে হচ্ছে, শেষতক ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ রপ্তানিতে তারা সম্মত। এরই মধ্যে হঠাৎ খবর এলো ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানোর’। রপ্তানিতে বিশেষ অনুমতি থাকলে এটা অবশ্য আমাদের বেলায় প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়। এরই মধ্যে এসে গিয়ে না থাকলে আমরা আশা করব, পেঁয়াজ অচিরেই আসবে। সমস্যা অবশ্য দেখা দিয়েছে অন্যখানে। পেঁয়াজ আসছে বলে খবর প্রচার হওয়ায় দেশে এর দাম গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। সেটা ভোক্তার জন্য সুখবর বটে। তবে গেল মৌসুমের অভিজ্ঞতায় যারা সোৎসাহে পেঁয়াজ ফলিয়েছিলেন, তারা হতাশ হয়েছেন। অবশ্য বসে থাকেননি। অনেক ক্ষেত্রে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করতে লেগে গেছেন তারা। তাদের আশঙ্কা, আমদানি শুরু হলে পেঁয়াজের দামে ধস নামবে। কিন্তু তাদেরকে কেউ বলেননি, ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ এলেও একবারে আসবে না। ধাপে ধাপে, অল্প করে আসবে। অত পেঁয়াজ একযোগে আমদানির সক্ষমতাও এ মুহূর্তে নেই। ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এলেও এলসি জটিলতার অবসান হয়নি। আমদানিতে ডলার তো লাগবে। সেটা এখনো সহজলভ্য নয়। তাছাড়া সরকার নিশ্চয়ই অবিবেচক নয়। সক্ষমতা থাকলেও একযোগে পেঁয়াজ এনে এর দামে ধস নামিয়ে দিতে তারা চাইবেন না। দেশে পেঁয়াজের মূল মৌসুম চলছে এখন। বেশ ক’মাস এটা দিয়েই চলতে হবে। ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ এলেও তা আমাদের বার্ষিক চাহিদার সামান্য অংশ মাত্র। পেঁয়াজের ফলন এবার কেমন, সেটা অবশ্য এখনো অস্পষ্ট। কী পরিমাণ জমিতে এর আবাদ হয়েছে, তা দিয়েই পুরোপুরি বোঝা যাবে না। উৎপাদনে অন্যান্য উপাদানের প্রভাবও রয়েছে। দামে ধস নামার আশঙ্কায় অপরিপক্ব পেঁয়াজ কতটা তুলে ফেলা হলো, তাতেও প্রভাবিত হবে ফলন। বীজ, সারের বিষয় রয়েছে। আছে আবহাওয়ার বিষয়। পেঁয়াজ যে পরিমাণ হাতে আসবে, তারও একাংশ হবে বিনষ্ট। এটা কমিয়ে আনতে পারলে ভালো হতো। উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক পেঁয়াজ আমাদের নষ্ট হয়। শুকিয়ে গিয়েও ওজন হারায়। এসবের হিসাব ঠিকমতো করা না হলে চাহিদা-সরবরাহের গোলমালে সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে। গেল মৌসুমে সম্ভবত এটাই হয়েছিল। পেঁয়াজের দাম গিয়েছিল অনেক বেড়ে। অতঃপর শুরু করতে হয় আমদানি। সেই চক্কর থেকে আজও আমরা বেরুতে পারিনি। দেশে কোনো পণ্যের ঘাটতি থাকলে আমদানিতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। এক্ষেত্রে সময়মতো আমদানি করতে পারাটা বড় বিষয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংকটে পড়ে আমদানি করতে গিয়ে অনেক সময় কর্তৃপক্ষকে দিশেহারা হতে হয়। সংকট অনুমান করে আমদানির উদ্যোগ হলো বিচক্ষণতা। বাড়তি চাহিদার সৃষ্টি হবে, এটা বুঝেও আগেভাগে আমদানির উদ্যোগ নিলে বাজার শান্ত রাখতে সুবিধা হয়। যেমন, রমজানে কিছু পণ্যের চাহিদা সবসময়ই লাফিয়ে বাড়ে এবং দুনিয়াজুড়ে, বিশেষত মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলোয় তা বাড়ে একযোগে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে উচিত হলো যত আগে সম্ভব ওইসব পণ্য আমদানিতে মনোযোগী হওয়া। তাতে কম দামেও আনা যেতে পারে। বাজারে দাম কম রাখতে শুল্ক ছাড় দিতে হলে সেটাও আগেভাগে দেওয়া উচিত। সংকট নিকটবর্তী হওয়ার পর এসব বেশি বেশি করলেও দেখা যায় সুফল মিলছে না। এবার চিনির বাজারে এমনটা ঘটতে দেখা গেল বলেই মনে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সরকার সয়াবিন তেলের যে দাম স্থির করেছে, তা বাজারে কার্যকর হলেও চিনির ক্ষেত্রে সেটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। ভারত থেকে অবশ্য আমরা চিনিও আনতে চাই ‘কোটা’য়। সেখানে এর দাম এখন অনেক কম। ডলারের বিদ্যমান দামে আর কর-শুল্ক মিটিয়ে আনলেও আমরা এক্ষেত্রে কম দামে চিনি পেতাম। সেটা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। চিনি আনতে হচ্ছে দূরবর্তী উৎস থেকে আর তাতেও দাম পড়ে যাচ্ছে বেশি। তারপরও চিনির দামটা যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে না। অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও চিনির দাম বেড়েই চলেছে এখানে। তাতে বেকারিসহ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে চলেছে। রমজানে মানুষ কষ্টে আছে চিনির দাম নতুন করে বেড়েছে বলে। খেজুরেও এবার স্বস্তি মিলছে না। বিশ্ববাজারে খেজুরের দাম কম হলেও দেশে এর সুফল পাওয়া গেল না যেসব কারণে তার মধ্যে রয়েছে এ পণ্য থেকে অধিক শুল্ক আহরণের চেষ্টা। তাতে খেজুর আমদানিও কমেছে; বেড়েছে দাম এবং কমেছে বিক্রি। খেজুর কম খেলেও অবশ্য চলে; কিন্তু একেবারেই চলে না চাল ও আটা-ময়দার মতো পণ্যের বাজার শান্ত না থাকলে। এবার আটা-ময়দার দাম অবশ্য নতুন করে বাড়েনি। কিন্তু বেড়েছে চালের দাম। এটা বৃদ্ধির প্রবণতায় রয়েছে, যা উদ্বেগজনক। মাঠে এখন বোরো ফসল। এর প্রকৃত উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সময়মতো চাল আমদানির ব্যবস্থাও করতে হবে। সরকার অবশ্য আমদানি না করে নিজ দেশের কৃষকদের কাছ থেকে বেশি করে বোরো সংগ্রহ করতে পারে। এর উপযুক্ত দাম নির্ধারণ করেই সেটা করতে হবে। তাতে কৃষকের জন্য ধানের লাভজনক দাম পাওয়ার পথ হবে সুগম। এক্ষেত্রে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থরক্ষার মনোবৃত্তি অবশ্য অনেক সময়ই দেখতে পাওয়া যায় না। শেষতক চালকল মালিকদের ওপর সরকারকে নির্ভর করতে দেখা যায় খাদ্যশস্যের মজুত গড়ে তোলার জন্য। আর সরবরাহের সংকট মেটাতে সময়ে সময়ে আশ্রয় নিতে হয় আমদানির। এ অবস্থায় ভারত থেকে আমদানিটাই আমাদের অগ্রাধিকার। দূরবর্তী অনেক দেশও চাল আমদানিতে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, ভারত এ মুহূর্তে চাল রপ্তানিতেও অনাগ্রহী। পেঁয়াজের মতো এটাও তারা কেবল কোটায় রপ্তানি করছে। সাধারণভাবে রপ্তানি করছে কেবল বাসমতি চাল। বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সবসময়ই ব্যগ্র। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি চালের মজুত তারা রাখতে চায়। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় ভারতে চাল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত বলেও খবর রয়েছে। এ অবস্থায় যারা ওখান থেকে সহজে চাল এনে ঘাটতি মেটাতে চায়, তাদেরকে হয়তো বিকল্প খুঁজতে হবে। চাল আনতে হবে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ পামঅয়েল আমদানি করি। সেক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। সবচেয়ে বড় পামঅয়েল উৎপাদনকারী এ দেশটি সময়ে সময়ে দিচ্ছে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা; বাড়াচ্ছে দাম। সেটাও মূলত স্থানীয় বাজার দেখভাল করতে গিয়ে। তখন আমাদের মালয়েশিয়ার দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে পামঅয়েল আমদানিতে। এ বিষয়ে ক’দিন আগে কিছু আলোকপাতের প্রয়াস পেয়েছিলাম। চাল আমদানিতে অবশ্য ভারত ছাড়াও একগুচ্ছ নির্ভরযোগ্য উৎস রয়েছে। সমস্যা একটাই-সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক ভারত চাল বেচতে না চাইলে এক্ষেত্রে তার প্রতিযোগীরা দেবে দাম বাড়িয়ে। সেক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, যেন অন্তত চালটা পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আরেক জরুরি খাদ্যপণ্য গমের ৯০ শতাংশই তো করতে হচ্ছে আমদানি। সেটাও ভারত আপাতত রপ্তানিতে রাজি নয়। এক্ষেত্রে সহজ বিকল্প কি হতে পারত অপর প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার? না বোধহয়। সেখান থেকে কিছু চাল অবশ্য আনা যেত। কিন্তু দেশটি আছে গৃহযুদ্ধের আগুনে এবং এর আঁচ এসে লাগছে আমাদের গায়েও। মিয়ানমারের সঙ্গে যেটুকু বাণিজ্য আমাদের হয়, সীমান্ত উত্তেজনায় সেটাও বন্ধ বলে খবর মিলছে। মিয়ানমার একটা স্বাভাবিক দেশ হলে তার সঙ্গে বাণিজ্য কিন্তু বাড়তে পারত। আপাতত বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতই আমাদের বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক। কৃষিপণ্য বাদে শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে অবশ্য বাধা নেই ভারতের দিক থেকে। জটিলতা রয়েছে আমাদের মধ্যে। সক্ষমতা কমেছে এবং উৎপাদনের তাগিদ কম বলেও সব দেশ থেকেই হালে আমরা আমদানি করছি কম। বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন থেকেও আমদানি কমেছে। এখন ভারত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি সম্ভব না হলে আমরা কি চীন থেকেও তা আনতে পারি? তুরস্ক আর মিসর থেকেও এর আগে পেঁয়াজ এনেছিলাম। তবে এ ধরনের কৃষিপণ্য, যার সিংহভাগই নিজেরা উৎপাদন করে থাকি, তার অবিবেচক আমদানি যেন কৃষকের জন্য হতাশাজনক হয়ে না দাঁড়ায়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক