বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশিতঃ এপ্রিল ৭, ২০২৪ | ৪:৩৩ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দেশে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সেবার অগ্রগতি হলেও বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও তা নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত সোডিয়াম বা লবণ গ্রহণ, তামাকের ব্যবহার, কায়িক শ্রমের অভাব, বায়ুদূষণ প্রভৃতি কারণে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি বিকল, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার মতো সমস্যাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। দেশে বর্তমানে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশই হচ্ছে এসব রোগে। মহামারির মত ছড়িয়ে পড়া এসব অসংক্রামক রোগ ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় সারা বিশ্বের মতো আজ (রোববার) দেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২৪।’ এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নিধারণ করা হয়েছে ‘মাই হেলথ, মাই রাইট’ অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতে কাজ করি একসাথে।’ প্রতিপাদ্যে গুণগত স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্যপ্রাপ্তির মতো মৌলিক অধিকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে বৈশ্বিক অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করেছে। সরকার মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, সরকার গত পনেরো বছরে চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি, জনবল নিয়োগ, স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আইন নীতিমালা প্রণয়নসহ এ খাতের উন্নয়নে কাজ করছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে শিশু, মাতৃমৃত্যু ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস এবং গড় আয়ু বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছে। ইপিআই কর্মসূচির আওতায় শিশু, কিশোরী ও নারীদের ১১টি রোগের টিকাদানে সফলতা পেয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে মোট জনগোষ্ঠীর ৯৪ শতাংশ মানুষকে টিকা দিয়েছে। ২০১৪ সালে পোলিওমুক্ত, ২০২৩ সালে কালাজ্বর ও ফাইলেরিয়াসিস নির্মূল স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে দেশীয় চাহিদার ৯৮ ভাগ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি বিশ্বের ১৯৭টি দেশে রপ্তানি করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের লক্ষ্য প্রত্যেক মানুষ যেন অর্থ ব্যয় ছাড়াই প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা সহজে পেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ অংসক্রামক রোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ু ও শব্দ দূষণের কারণে সৃষ্ট রোগসহ ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে একজন মানুষের ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। বিপর্যয়মূলক চিকিৎসা ব্যয় অসংখ্য রোগীকে দারিদ্রসীমায় ঠেলে দিচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এখন যেভাবে চলছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে জোর দিয়ে এখনই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত চ্যালেঞ্জ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ‘অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এতে বেশকিছু তথ্য ও সুপারিশ তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়লেও তা মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দ খুবই কম। মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতীয় বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দিলেও, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য দেশের প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত চিকিৎসা পৌঁছে দিতে হবে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি ঠিকভাবে কাজ করে তাহলেই তা সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ৪২টি ১০০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। চিকিৎসকের সংখ্যা ১০ হাজার থেকে বেড়ে ৩০ হাজার হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইপিআই টিকাদান প্রায় ৯৪ শতাংশ সফল হয়েছে। রাতকানা রোগ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বর্তমানে ৫ বছরের কম বয়সি খর্বকায় শিশুর জন্মের সংখ্যা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘কেবল উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমেই অসংক্রামক রোগের প্রকোপ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্যসেবার মূলনীতি হচ্ছে সব মানুষের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে গুণগত মানের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভুটান এবং শ্রীলংকার চেয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এ ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।