২৩৯ বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ, যার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অটল মনমোহন মোদি

প্রকাশিতঃ এপ্রিল ১৪, ২০২৪ | ৬:৫৬ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে চলছে সাধারণ নির্বাচনের তোড়জোড়। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র শাসনের ভার কাদের হাতে থাকবে– পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ তথা লোকসভা নির্বাচনে জয়-পরাজয় সেটি নির্ধারণ করবে। ভারতে লোকসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। সাত ধাপে এই ভোট গ্রহণ শুরু হবে ১৯ এপ্রিল, চলবে ১ জুন পর্যন্ত। ভোটের ফলাফল ঘোষণা হবে আগামী ৪ জুন। বর্তমান লোকসভার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৬ জুন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। সেখানে প্রায় ৯৭ কোটি নিবন্ধিত ভোটার রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের তামিলনাড়ুর সালেম জেলার মেত্তুরের বাসিন্দা কে পদ্মরাজন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অটল বিহারী বাজপায়ী, মনমোহন সিং, পিভি নরসিমা রাও, তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এবার তার নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩৯টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কে পদ্মরাজন, যিনি ‘ইলেকশন কিং’ নামে পরিচিত। খবর বিবিসির। বিবিসি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত কে পদ্মরাজন ভারতের ১২টি রাজ্যের বিভিন্ন আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বিধানসভা, সংসদ নির্বাচন এবং এমনকি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচনও এই তালিকায় রয়েছে। প্রসঙ্গত, ভারতের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য যেকোনো ব্যক্তি যে কোনো জায়গা থেকে ভোটে লড়তে পারেন। এর জন্য তাকে হলফনামা দাখিল করতে হবে। কে পদ্মরাজন বিবিসিকে বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমার লক্ষ্য আরও বেশি নির্বাচনে হারা।’ বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু এটাই তার ইচ্ছা। এবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ‘ইলেকশন কিং’ নামে পরিচিত পদ্মরাজন ভোটে লড়ার বিষয়ে কীভাবে আগ্রহী হলেন? স্কুলের পড়া শেষ করার আগে থেকেই সাইকেল মেরামতের কাজ শুরু করেন তিনি। ‘ডিস্টেন্স এডুকেশনের’ মাধ্যমে ইতিহাসে স্নাতকের ডিগ্রি লাভ করার পরেও কে পদ্মরাজনের মূল পেশা কিন্তু এখনো সেই সাইকেল মেরামতই। ২৩৯টি নির্বাচন লড়ার জন্য অর্থ কোথা থেকে এসেছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে পদ্মরাজন জানিয়েছেন কষ্টার্জিত কোটি টাকা খরচ হয়েছে ভোটে লড়তে। কেন নির্বাচনি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাধ হলো সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সাইকেলের দোকানে বসে হঠাৎই একদিন আমার ভোটে লড়াই করার ইচ্ছে হলো। সেটা ১৯৮৮ সালের কথা। তারপর আমার পুরো জীবনই বদলে যায়।’ তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছে জানতে পেরে বন্ধুরা মস্করা করেন। একজন সাইকেল মেরামতের দোকানের মালিক কীভাবে ভোটে লড়বেন সে নিয়ে তাকে কথাও শুনতে হয়েছিল। আর ঠিক এই কারণেই এখন পর্যন্ত ২৩৯টি নির্বাচনে লড়ছেন তিনি। পরিবারের সদস্যরাও কী তার এই জেদকে সমর্থন করেন? এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম বিরোধিতা করেছেন বটে কিন্তু এখন আমার কথা বুঝতে পারেন তারা।’ কে পদ্মরাজনের ছেলে শ্রীজেশ এমবিএ করেছেন। বাবার জেদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলেবেলায় যখন লেখাপড়া করতাম তখন বাবার ওপর রাগ হতো। আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম উনি কী করছেন। এখন বড় হয়ে বুঝতে পারি বাবার লক্ষ্য কী?’ তিনি আরও বলেন, যে কেউ নির্বাচনে লড়তে পারেন এই বার্তা তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চান। তারপর থেকে আমি সব সময় বাবাকে সমর্থন করে এসেছি। টানা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে কে পদ্মরাজন এবং তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কে পদ্মরাজনের দাবি, ১৯৯১ সালে উপনির্বাচনে অন্ধ্রপ্রদেশের নন্দিয়াল থেকে পিভি নরসিমা রাওয়ের বিরুদ্ধে মনোনয়ন জমা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু লোক তাকে অপহরণ করে। অপহরণকারীদের খপ্পর থেকে কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। তবে এ ঘটনা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছায় কোনো প্রভাব ফেলেনি বলে দাবি করেছেন পদ্মরাজন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ছাড়াও পদ্মরাজন ২০০৪ সালে লক্ষ্ণৌ থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ী, ২০০৭ ও ২০১৩ সালে আসাম থেকে মনমোহন সিং এবং ২০১৪ সালে ভদোদরা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন, আবদুল কালাম, প্রতিভা পাতিল, প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং রামনাথ কোবিন্দের পাশাপাশি বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বিরুদ্ধেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তামিলনাড়ুতে কে করুণানিধি, জে জয়ললিতা, এম কে স্ট্যালিন এবং ই কে পালানিস্বামী, কর্ণাটকে সিদ্দারামাইয়া, বাসবরাজ বোম্মাই, কুমারস্বামী এবং ইয়েদুরাপ্পা, কেরালায় পিনারাই বিজয়ন এবং তেলেঙ্গানায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মতো মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ভোটে। যে কেন্দ্রে থেকে তিনি ভোট লড়েন, সেখানে প্রচার করেন কি না সে কথা জিজ্ঞাসা করা হলে কে পদ্মরাজন জানিয়েছেন তিনি প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিলেও নির্বাচনি প্রচার করেন না। শুধুমাত্র মনোনয়ন দেওয়ার জন্যই খ্যাত এই ব্যক্তি কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন। তিনি ২০১৯ সালে কেরালার ওয়ানাড় কেন্দ্রে তিনি রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তার ঝুলিতে এসেছিল ১৮৮৭টি ভোট। তবে এমনও হয়েছে যে ভোটে দাঁড়িয়ে তার নিজের ওয়ার্ডে একটা ভোটও পাননি পদ্মরাজন। আবার ২০১১ সালে মেত্তুর বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬,২৭৩ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। আজ পর্যন্ত যে কয়টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি তাতে এটিই তার ঝুলিতে থাকা সর্বোচ্চ ভোট। পদ্মরাজনের নীতি কিন্তু একেবারে ‘অন্য’। ভোটে হেরে যাওয়াই তার নীতি। এই কারণে পদ্মরাজনের নাম লিমকা বুক অফ রেকর্ড-এ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী হিসাবে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নিজের নাম দেখতে চান তিনি। এ রেকর্ড রয়েছে অন্য এক ভারতীয়র ঝুলিতে। কে পদ্মরাজনের আগে চাচা যোগিন্দর সিং ধরতিও ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ‘ধরতি পকড়’ নামে পরিচিত কাকা যোগিন্দর সিং ১৯৬২ সাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে যখন তার মৃত্যু হয় ততদিনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ফেলেছিলেন প্রায় ৩০০টি নির্বাচনে। তিনি স্থানীয় পর্যায় থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তিনিও ভোটে হারার উদ্দেশ্যেই লড়তেন যদিও অংশ গ্রহণ করতেন নির্বাচনি প্রচারে। তার প্রচার ছিল অন্যরকম। নির্বাচনি এলাকায় প্রচার করে তাকে ভোট না দেওয়ার জন্য জনগণের কাছে আবেদন করতেন চাচা যোগিন্দর সিং। ফিরে আসা যাক কে পদ্মরজানের কথায় যিনি এইবার তামিলনাড়ুর ধর্মপুরী আসন থেকে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। অন্যান্য বারের মতো এইবারও ‘পরাজয়ই’ যে তার জন্য অপেক্ষা করছে সে বিষয়ে নিশ্চিত তিনি। কিন্তু ‘ধরতি পকড়’-এর ঝুলিতে থাকা ৩০০টা নির্বাচনের রেকর্ডকে ভাঙতে বদ্ধপরিকর এই ‘ইলেকশান কিং’।