একদিকে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট, অন্যদিকে সরকারকে চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি ঋণের জোগান দিতে গিয়ে ব্যাংক খাতের নাভিশ্বাস উঠেছিল। এর মধ্যেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিলের সুদের হার নানা কৌশলে চাপিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আইএমএফ-এর পরামর্শে চড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে মুদ্রানীতি ব্যবহার করতে গিয়ে ঋণের সুদহার বাড়াতে হয়েছে। তখনই ‘পাগলা গোড়া’র গতিতে বেড়েছে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার। গত দুই বছরে এর সুদ বেড়েছে সাড়ে তিনগুণের বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্যান্য ঋণের সুদহারও। একই সঙ্গে অন্যান্য বিল বন্ডের সুদহারও বেড়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে এখন সুদ বাড়ার দৌড় চলছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ঋণগ্রহীতারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি স্বীকার করে নিয়ে তাদের জন্য কিস্তিতে সীমিত ছাড় দিয়েছে। তবে এতে কোনো সুফল মিলবে না-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসাবে সংস্থাটি বাংলাদেশকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে দাম বাড়তে থাকে। তখন বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতিও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ শতাংশের ঘরে ওঠে, যা দেড় বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকেই সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানো ছাড়া বাজারে ঋণের সুদহার তেমন একটা বাড়ায়নি। ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তা ঋণ ছাড়া বাকি সব খাতেই ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশে বেঁধে রাখে। এতে মূল্যস্ফীতি কমেনি, উলটো বেড়েছে। আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করার ওপর জোর দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের জন্যও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে ঋণের সুদহার বাড়াতে করিডর ঘোষণা করে। এতে সুদহার বাড়ানোর জন্য সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারকে ভিত্তি ধরা হয়। এর সঙ্গে নির্ধারিত অংশ যোগ করে জুলাই থেকে সব ধরনের ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর পর থেকেই ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ‘পাগলা ঘোড়া’র গতিতে বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অন্যান্য ঋণের সুদহারও। আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণত ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হারকে ভিত্তি ধরে এর সঙ্গে কিছু অংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়। লন্ডন ইন্টার ব্যাংকে বিভিন্ন উপকরণ আছে। এর মধ্যে লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটে (লাইবর) সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছয় মাস মেয়াদি ডলার ও ইউরো বন্ড। মঙ্গলবার এর সুদ ছিল ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর সঙ্গে দুই বা তিন বা আরও কম-বেশি যোগ করে সুদ নির্ধারিত হয়। আগে লাইবর রেট ছিল দেড় শতাংশের নিচে। ছয় মাস মেয়াদি ইউরো বন্ডের রেট এখন ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মার্কিন মুদ্রাবাজারে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। আগে ছিল ২ শতাংশের নিচে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বাংলাদেশে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদ ছিল ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২২ সালের মার্চে তা সামান্য কমে ৩ দশমিক ০৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর জুনে তা দ্বিগুণ বেড়ে ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে ওঠে। ওই সময়ে ট্রেজারি বিল বিক্রি করে সরকারের ঋণের চাহিদাও বেড়ে যায়। একই সময়ে ব্যাংকে ছিল তারল্য সংকট। যে কারণে সুদহার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে সামান্য কমে তা ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে দাঁড়ায়। ওই বছরের ডিসেম্বরে তা আবার বেড়ে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশে ওঠে। ২০২৩ সালের মার্চে সামান্য কমে ৭ দশমিক ০১ শতাংশে নামে। জুনে আবার বেড়ে ৭ দশমিক ০৭ এবং সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশে ওঠে। ডিসেম্বরে এক লাফ দিয়ে ওঠে ১১ দশমিক ০৯ শতাংশে। জানুয়ারিতে তা আরও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে ১১ দশমিক ৪২ শতাংশে ওঠে। মার্চে গড় সুদ দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর সঙ্গে সাধারণ ঋণে ৩ শতাংশ যোগ করে সুদ হচ্ছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত ছিল ৮-৯ শতাংশ। কৃষি ও পল্লিঋণে ২ শতাংশ যোগ করে সুদ হচ্ছে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা জুন পর্যন্ত ছিল ৮ শতাংশ। ভোক্তা ঋণে সুদ আগে ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে। জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে সুদহার বেড়েছে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। ট্রেজারি বিলের সুদ বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণের বেশি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদ ৪ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। উলটো এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত মাসে এ হার বেড়ে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে। ইউরোপের মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমেছে। এদিকে ব্যাংকে তারল্য কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালের জুনে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এখন তা ৪ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর মধ্যেও সরকার বাড়তি ঋণ নিচ্ছে। গত অর্থবছর সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নিয়েছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিচ্ছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বেড়েছে। ২০২১ ডিসেম্বরে সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২৩ সালের মার্চে তা আরও ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা হয়। জুনে আরও বেড়ে ৪১ হাজার ২৮০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে ৪১ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা হয়। ডিসেম্বরে আবার ২৮ হাজার ১০ কোটি টাকায় নেমে আসে। তারপরও ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। বাজারে সরকারের চারটি ট্রেজারি বিল ও ৫টি বন্ড রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ১৪, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল। বন্ডের মধ্যে রয়েছে ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড। সবকটির সুদের হারই বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদ, যা সাড়ে ৩ গুণের বেশি। অন্যগুলোর সুদহার দ্বিগুণের কম বেড়েছে।