আমরা যেন ধীরে ধীরে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে চলেছি। বর্তমান বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে একদিকে যেমন আমাদের কায়িক পরিশ্রম কমেছে; অন্যদিকে তেমন বেড়েছে ব্যস্ততা, স্ট্রেস, হতাশা। আর সেই সঙ্গে খাদ্যে ভেজালের ফলে আমাদের শরীরবৃত্তীয় কাজের ভীষণ ব্যঘাত ঘটছে। ফলে দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন রোগ ও জীবাণু। যার আক্রমণে তটস্থ থাকতে হচ্ছে সাধারণ মানুষসহ বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী-গবেষকদের। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রোগ-জীবাণুর আক্রমণ হচ্ছে; যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে চলেছে। প্রাকৃতিক রোগশক্তির আক্রমণ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তথা জীবনীশক্তি প্রতিহত করতে পারছে না। ফলে খুব সামান্য কারণেই আমরা রোগাক্রান্ত হচ্ছি। ভেজাল খাদ্য ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের কারণে এক রোগশক্তি রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে আরও শক্তিশালী হয়ে নতুন ও জটিল কোনো রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে আমাদের জীবনীশক্তি ওই রোগ শনাক্ত করতে না পেরে নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমরা জানি, প্রতিটি মানুষের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে; যা শরীরের ক্ষতি করে এমন কিছু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি প্রবেশে বাধা দেয়। ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে শরীরের শত্রুকে মোকাবিলা করে; কিন্তু কেউ অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভুল করতে থাকে। শত্রু এবং সুস্থ কোষের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে না পেরে শরীরের সুস্থ কোষ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করতে থাকে। এতে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। এদিকে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। তারাও প্রতিনিয়ত গবেষণা করে চলেছে। তৈরি করছে করছে নতুন নতুন প্রতিষেধক। আর এটি নাম দেওয়া হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক। কিছুদিন এ অ্যান্টিবায়োটিক সাময়িক কাজ করলেও এক সময় সেটিও রোগশক্তির কাছে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে জটিলতা আরও বাড়ছে। শুধু তাই নয়, এই অ্যান্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট একটি জটিলতা উপশম করতে পারে বটে; তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাব আরও মারাত্মক; যা শরীরে অনেক জটিলতা তৈরি করে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এক সময় জীবনবিধ্বংসী হয়ে দেখা দেয়; যা এক সময় মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়; ভয়ের আরও কারণ আছে। বর্তমান সময়ে জীবনধারণকারী খাদ্যপণ্য দ্রুত বর্ধনশীল করতে অসাধু উপায়ে যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক ও বিষাক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে আমাদের বেঁচে থাকা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এক সময় কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধই আমাদের শরীরে কাজ করবে না; বিজ্ঞানীরা এর ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন ইতোমধ্যেই। আর এক সময়ের সেরা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বর্তমানে অনেকের শরীরে কোনো কাজই করছে না; বরং এর ব্যবহারে অন্য জটিল প্রভাব দেখা দিচ্ছে। এদিকে আরও বিষয় হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক এমন কিছু ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে দেয় যা শরীরের জন্য উপকারী। সম্প্রতি একটি সংবাদপ্রত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না মানুষের শরীরে। ৮২ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা হারিয়েছে জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধটি। পাঁচ বছর আগে যা ছিল ৭১ শতাংশ। সেই হিসাবে পাঁচ বছরের মধ্যে এ ওষুধের অকার্যকারিতার হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে সেফট্রিয়েক্সন গ্রুপের ওষুধ। সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আইইডিসিআর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. জাকির হাবিব গবেষণাটি উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের পরিস্থিতি কী তা জানতে ২০১৭ সাল থেকে গবেষণা করছে আইইডিসিআর। এ বছর জুন পর্যন্ত চলে এ গবেষণা। দীর্ঘ সাত বছরে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার নমুনা নিয়ে এ গবেষণায় পরিচালনা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিদের অতিরিক্ত ব্যবসায়ী মনোভাব, অপ্রয়োজনে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লেখার প্রবণতা এবং ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধের দোকানে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সমাধান পেতে সংবেদনশীলতা পরীক্ষা ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। গবেষণা বলছে- ৮২ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা হারিয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক; যা গেল পাঁচ বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। এ বছর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে সেফট্রিয়েক্সন গ্রুপের ওষুধ। গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি ৬১ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইসিইউ রোগী ২৬ শতাংশ ও বহির্বিভাগ চিকিৎসা নেওয়া ১৩ শতাংশ রোগী। এক অনুষ্ঠানে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক চিকিৎসক ডা. ফরহাদ মারুফ বলেন, বিশ্বজুড়ে এ সুপারবাগ ইনফেকশনে বছরে মারা যাচ্ছে ৫০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ এ রোগে মারা গেছেন। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে ভোগা রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বেশি হচ্ছে। সম্প্রতি একটি সংবাদপ্রত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ব্যবহৃত বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় উঠে এসেছে- দেশে ব্যবহৃত বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। মারণঘাতী ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে বাঁচতে অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের জীবনে এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। তবে এর অপব্যবহারের কারণে যে একদিন বিপর্যয় নেমে আসবে- এমন সতর্কবাণীও করে গিয়েছেন অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক স্বয়ং আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। এত সব ভয়ংকর সব তথ্যের মধ্যে ভালো খবর হলো- নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, কায়িক পরিশ্রম তথা ব্যায়াম আর সঠিক ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের জীবনীশক্তিকে উজ্জীবিত করে রোগ উপশম নয় নিরাময়ের পথে চলা। আর এ পথ ২০০ বছর আগেই দেখিয়েছেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান হোমিওপ্যাথির জনক ক্রিস্টিয়ান ফ্রিডরিখ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। তিনি গবেষণা ও পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন- আমাদের জীবনীশক্তি বিকৃত হলেই শরীর ও মনে নানারকম নানারকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে নানারকম লক্ষণ প্রকাশ করে। যাকে আমরা রোগ হিসেবে অভিহিত করি। জীবনীশক্তি তার স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুত হলেই শরীর এবং মনে ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের সূচনা হয়। যেমন- টিউমারের সৃষ্টি হওয়া, পাথর তৈরি হওয়া, ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের আক্রমণ, কোনো অঙ্গ সরু, মোটা হওয়া বা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। ফলে বিকৃত হয়ে যাওয়া জীবনীশক্তিকে সঠিক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে সুস্থ করতে পারলেই আমাদের শরীর রোগমুক্ত হবে। আর এ কাজ করে থাকেন একজন হোমিও চিকিৎসক। তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সঠিক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে বিকৃত হয়ে যাওয়া জীবনীশক্তিকে সুস্থ করতে পারেন। ওষুধ প্রয়োগে জীবনীশক্তিকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে শরীরের নিজস্ব রোগ নিরাময় ক্ষমতাকে ব্যবহার রোগমুক্তি অর্জন করাই হলো প্রাকৃতিক এবং সঠিক পদ্ধতি। আর এটা সর্বজন বিদিত যে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রকৃতি মুহূর্তের মধ্যে কিছু ধ্বংসও করে না আবার চোখের পলকে কিছু সৃষ্টিও করে না। প্রকৃতি তার সব কাজই করে আস্তে-ধীরে, রয়ে-সয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে। ডা. লোরেইন ডের মতে, প্রচলিত অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিসমূহ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত ইমিউন সিস্টেমকে পুনরায় শক্তিশালী করার মাধ্যমে রোগ নির্মূল করে থাকে। যেহেতু যেকোনো রোগের অন্য প্যাথির চিকিৎসা করালে প্রচুর ওষুধ খেতে হয়। আর এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। আর অন্য যেকোনো ওষুধের বা খাদ্যের বিষক্রিয়া নষ্ট করার ক্ষমতা একমাত্র হোমিওপ্যাথিক ওষুধেরই আছে। ফলে এ কথা বলাই যায়, হোমিওপ্যাথি হলো পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান; যা মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করবে।