মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, যেখানে সুপারিশ করা হয়েছিল, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেওয়া হবে।’ নিরাপত্তা পরিষদে একমাত্র ‘না’ ভোট প্রস্তাবনাটিকে পরাজিত করে। বর্তমান মার্কিন নীতি ‘একটি ব্যাপকভিত্তিক শান্তিচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’কে সমর্থন করে, যা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার অবস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন এই বলে যে, ‘একমাত্র বাস্তব সমাধান হলো দ্বিরাষ্ট্র সমাধান।’ অসলো চুক্তির রাজনৈতিক প্রভাব এবং একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে চলা বাগাড়ম্বর বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের মধ্যে এ ভুল ধারণা তৈরি করেছে যে, ফিলিস্তিনিদের মূলত একটি রাষ্ট্র রয়েছে। অনেকে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার পুরো অংশকে ‘ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা মানচিত্র দেখেন। তারা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এবং প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কথা শুনেছেন। অনেক সাধারণ পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হতে পারে, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সরকারের পাশাপাশি সম্ভবত একটি রাষ্ট্রের কাছাকাছি কিছু রয়েছে। বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের কখনোই সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল না। সার্বভৌমত্বের মানে হলো, একটি রাষ্ট্রের একটি অর্থবহ অঞ্চল, জনসংখ্যা ও একটি সরকার থাকা, যে সরকার দেশের ভেতর বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। যদিও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি সেখানে বসবাসরত অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্বশাসন। অধিকাংশ মানুষই মনে করবেন, রাষ্ট্রের ভূমি রক্ষা করার ক্ষমতা এবং বাইরের অনুপ্রবেশকে প্রতিরোধ করাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিনকে শাসনের জন্য এমন কোনো সংজ্ঞায়িত ভূখণ্ড কখনোই ছিল না, যা রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পারে। পশ্চিম তীর ও গাজার বিচ্ছিন্নতাকে একপাশে রেখে, যার জন্য এক সময় সম্ভাব্য সমাধান ছিল, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে কখনোই পশ্চিম তীরের ওপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি। এটি কখনোই কোনো ধরনের সংলগ্ন অঞ্চলকে শাসন করেনি। মানচিত্রের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় দ্বিতীয় অসলো চুক্তি (পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার অন্তর্বর্তী চুক্তি, যা সাধারণত অসলো দ্বিতীয় বা অসলো ২ নামে পরিচিত) কীভাবে পশ্চিম তীরকে এ, বি ও সি অঞ্চলে বিভক্ত করেছে; ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম তীরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বিন্দুর ওপর কর্তৃত্ব রয়েছে, যেগুলো ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা দ্বারা বিভক্ত। মানচিত্রে আরও বোঝা যায়, পশ্চিম তীরের গভীরে ইসরাইল যে প্রাচীর তৈরি করেছে ও বসতির সম্প্রারণ ঘটিয়েছে, তা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, এখন এমন কোনো অঞ্চল নেই যা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ শাসন করতে পারে। উপরন্তু, ইসরাইল যখন রাস্তা, প্রাচীর বা ইসরাইলি বসতি নির্মাণের জন্য ফিলিস্তিনি জমি নিয়ে যায়, তখন ফিলিস্তিনিদের তা প্রতিরোধ করার উপায় খুব কমই থাকে অথবা কোনো উপায়ই থাকে না। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নীতি প্রণয়ন করতে পারে; কিন্তু এর অনেকগুলোরই বাস্তবায়নের বাস্তবসম্মত ক্ষমতা তাদের নেই। বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। পশ্চিম তীরে একাধিক নিরাপত্তা চৌকি কিংবা ভবন তথা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য, পণ্য পরিবহণ অথবা মানুষের যাতায়াতের জন্য ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলের অনুমতির প্রয়োজন হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইসরাইল পশ্চিম তীরের পানিসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইসরাইলিরা সেই পানির বেশিরভাগ অংশ ভোগ করে। এমনকি ইসরাইল ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে এবং কখনো কখনো তাদের তহবিলও আটকে রাখে, যে অর্থ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আর্থিক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে। গেল কয়েক দশক ধরে গাজার অর্থনীতিতে ইসরাইলের উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং হামাস ২০০৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসরাইল কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা অর্থনীতিকে বিপাকে ফেলে। ইসরাইলের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অনুমিত শাসন করার এলাকাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে তার সীমিত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং ইসরাইলি বাহিনী নিয়মিতই ফিলিস্তিনি শাসিত এলাকায় কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করে। এমনকি ফিলিস্তিনিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রশাসনিকভাবে আটকে রাখতে পারে ইসরাইলি বাহিনী। তদুপরি, মার্কিন নেতারা, যারা দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের আহ্বান জানান, তারা কদাচিৎ এমন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কল্পনা করেন, যে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা চাক শুমার সম্প্রতি একটি ভাষণ দিয়েছেন, যেখানে তিনি এমন একটি দ্বিরাষ্ট্রকে এ সমস্যার ‘একমাত্র বাস্তব ও টেকসই সমাধান’ বলে উল্লেখ করেছেন, যেখানে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ‘অসামরিককরণ’ করা হবে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অনেক ত্রুটি রয়েছে; কিন্তু তবুও সার্বভৌমত্বের মৌলিক উপাদানগুলো তথা গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা না থাকলে একটি সম্পূর্ণ যোগ্য কর্তৃপক্ষও ব্যর্থ হয়। যদি ভবিষ্যতে দ্বিরাষ্ট্রই হয় কার্যকর সমাধান, তাহলে এর প্রবক্তাদের স্বীকার করা উচিত যে, অসলো প্রক্রিয়া যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, তাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রকৃত অগ্রগতি ব্যর্থ হয়েছে। যে কোনো নতুন শান্তি প্রচেষ্টা শুরু করার আগে উচিত বেশকিছু মূল বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। প্রথমত, ভূমি ও জনগণ উভয়ের ওপর সংলগ্ন ভূখণ্ড এবং প্রকৃত সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনিরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে শিখেছে যে, এটি একটি প্রতারণামূলক ফাঁপা প্রতিশ্রুতি। কাজেই এটি স্পষ্ট যে, বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে তারা আর এ আশাকে লালন করবে না-যে পদক্ষেপগুলো আজ খুব কম ইসরাইলিই নিতে ইচ্ছুক। তৃতীয়ত, অর্থনীতিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হয়, তা কখনো কাজ করে না। যেমন, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত ধারণাগুলো। চতুর্থত, ইসরাইলি নেতারা সামান্য পরিমাণেও একটি সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা মেনে নেননি। ১৯৯৩ সালের প্রথম অসলো চুক্তিতে ইসরাইল ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসাবে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে স্বীকৃতি দেয়; কিন্তু ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরাইলি নেতারা যারা আন্তরিকভাবে সত্যিকারের শান্তি চেয়েছিলেন, তারাও সীমিত স্বাধীনতাসহ একটি নিরস্ত্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, অনেক ইসরাইলি নেতা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ‘স্বায়ত্তশাসনের’ ধারণাকে প্রচার করেছিলেন-যে ভূমি ও নিরাপত্তার ওপর ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মতো অন্য নেতারা কখনোই সততার সঙ্গে এটিও সমর্থন করেননি। এসব বাস্তবতায় দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানকে অসম্ভব বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার পরিবর্তে একটি ভালো পন্থা হতে পারে নীতি সমন্বয়, যার অর্থ হলো একটি সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন-একটি দ্বিরাষ্ট্র সমাধান অথবা সংঘাতের মাধ্যমে সমাধানের জন্য আরেকটি প্রস্তাব আনা। আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস কেরি বয়েড অ্যান্ডারসন : আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক