দেশের ৪৩টি জেলার ওপর দিয়ে বাংলাদেশ রেলের ৩১৫৭টি লেভেল ক্রসিং গেট রয়েছে। যার মধ্যে ১৪৭৭টি লেভেল ক্রসিং অবৈধ। আবার বৈধ ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৪৯.৭৩ শতাংশ গেটে গেটম্যান রয়েছে। ৫০.২৭ শতাংশ গেট উন্মুক্ত, অর্থাৎ গেটম্যান নেই। বৈধ কিংবা অবৈধ ক্রসিংগুলো ২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৭৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এমন অবস্থায় এলজিইডির আওতায় পল্লী সড়ক নেটওয়ার্কে অবস্থিত অবৈধ, অরক্ষিত ও চরম বিপজ্জনক রেলক্রসিংগুলোর অপসারণ বা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুটি সংস্থার মধ্যে ‘দ্বন্দ্ব’ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ঘটনা কিংবা প্রাণহানির ঘটনায় কোনো সংস্থাই দায় নিচ্ছে না। আবার উভয় সংস্থার সমন্বয়ে পরিচালিত জরিপের সুপারিশও কেউ আমলে নিচ্ছে না। অবৈধ ক্রসিং এবং নিরাপত্তাহীন গেটের কারণে ট্রেনের গতি দিন দিন কমছে। এজন্য সমাপ্ত হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের সুফলও যথাযথভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থেকে টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত মোট ৪৭টি রেলক্রসিং রয়েছে। যার মধ্যে ১৬টি অবৈধ। এ পথ ধরে প্রতিদিন ৭৯ জোড়া অর্থাৎ ১৫৮টি ট্রেন চলাচল করে। রাজধানী হয়ে এসব ট্রেন চলাচলের কারণে সারা দিন ৩১৬ বার প্রতিটি রেলক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধকগুলো ফেলা হয়। প্রতিবার গড়ে ৩ মিনিট করে রেলক্রসিং বন্ধ করে রাখা হয়। সেই হিসাবে একটি রেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে প্রতিদিন ৯৪৮ মিনিট বা ১৫.৪ ঘণ্টা করে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এমনটা প্রায় সারা দেশেরই চিত্র। মোট ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ৩টি ক্রসিংয়ে আন্ডারপাস রয়েছে। রাজধানীর মালিবাগ। সকাল ১০টা, স্কুল ও অফিস সময়। ব্যস্ত সড়ক দিয়ে স্কুলপড়ুয়া, অফিসযাত্রী থেকে সাধারণ মানুষ সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান, সিএনজি বা বাসে যে যার মতো গন্তব্যের দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ-ই সবাইকে থমকে যেতে হলো। কারণ, মালিবাগ রেলগেট ততক্ষণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাত্রী কিংবা মালবাহী ট্রেন আসছে। শুধু সুস্থ মানুষ কেন, পুলিশের জরুরি বাহন, রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সেরও একই দশা। গন্তব্যের অপেক্ষা। কখনও সে অপেক্ষা ৭ মিনিট, কখনও বা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। রেলওয়ের মহাপরিচালক দপ্তর থেকে পাওয়া একটি জরিপের সুপারিশমালা হাতে এসেছে। রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক জরিপপত্র থেকে জানা যায়, রেলে ট্রেনের যথাযথ গতি না উঠা এবং অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অবৈধ এবং অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে যুগের পর যুগ বলা হচ্ছে-অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধ করতে। প্রহরীবিহীন ক্রসিংগুলোতে গেটম্যান প্রদানসহ সবকটি ক্রসিং আধুনিক করার। কিন্তু, কোনো সুপারিশই কাজে আসছে না। জরিপ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর রেলপথ সচিবের সভাপতিত্বে ক্রসিং সংক্রান্ত একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক রেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে নির্মিত অবৈধ রাস্তার বিষয় নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তা হলো-ক্রসিংগুলো বন্ধ কিংবা আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ করার। ওই জরিপের সুপারিশে আরও বলা হয়, ১৪৩৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে অতিঝুঁকির ৬২টি ক্রসিং সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। রাজধানী ও বড় শহর ঘিরে থাকা ৪৭টি ক্রসিংয়ে আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ করার পাশাপাশি ৫৭৭২ জন লোকবল নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া ১৯৪টি গেটে সিগন্যাল অটোমেশন, ১০৮টি গেটের শ্রেণি উন্নীতকরণ এবং ২৩১টি গেটকে নিকটবর্তী গেটের সঙ্গে সমন্বয় করে হ্রাস করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই জরিপ ও সুপারিশমালার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতির ট্রেন আনা হচ্ছে। প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ এবং প্রহরীবিহীন গেটে গেটম্যান নিয়োগের বিষয়ে কোনো প্রকল্পই নেওয়া হচ্ছে না। এলজিইডি কর্তৃকও কোনো সমাধান আসছে না। রেলওয়ের আইন অনুযায়ী এলজিইডি, সওজ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ নানা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক নির্মিত লেভেল ক্রসিং সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে রেল বলছে, সংস্থাগুলো কর্তৃক অবৈধভাবে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোতে আন্ডার কিংবা ওভারপাস করে দিতে। এছাড়া কিছু ক্রসিংয়ে লোকবল দিয়ে চালাতে। অতিঝুঁকির সবকটি বন্ধ করে দিতে। সুপারিশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পত্রও প্রেরণ করা হয়েছে। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. আরিফুজ্জামান বলেন, রেলের প্রায় অর্ধেক লেভেল ক্রসিং অবৈধ-অরক্ষিত। এজন্য রেল কিছুতেই দায়ী নয়। এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ নানান বেসরকারি সংস্থা অবৈধভাবে লেভেল ক্রসিং করেছে এবং করেই যাচ্ছে। আমরা অনেকগুলো বন্ধ করলেও কয়েক দিন যেতেই তা পুনরায় চালু করে ফেলা হচ্ছে। আমাদের বৈধ ক্রসিংগুলোতেই লোকবলসহ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার ওপর অবৈধগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানিসহ রেলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যাদের জন্য এমনটা হচ্ছে-সেই সব সংস্থাগুলো দায় নিচ্ছে না। অবৈধ ক্রসিংগুলো সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের নয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামছুল হক বলেন, রেল এবং বেসরকারি সংস্থার ঠেলাঠেলিতে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং হয় কী করে? এটা প্রতিরোধের দায়িত্ব কার? আবার দিনের পর দিন অবৈধ ক্রসিংগুলো দিয়ে যানবাহনও চলছে। কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতেই হবে। রেলে যে বরাদ্দ হচ্ছে, তার কতটুকুই বা রেলপথ নিরাপত্তায় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ক্রসিং কিংবা রেলপথ সব সময় অবহেলিত থাকছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) ড. মো. আমিনুল রহমান বলেন, লেভেল ক্রসিংগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, এটি খুবই দুঃখজনক। আমি নতুন দায়িত্বে এসেছি। নিশ্চয় বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করব। কি করে এর সমাধান করা যায়। দুই সংস্থাই সরকারি, এর সমাধানতো হতে হবে। আমি এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করব।