উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ফের মুখোমুখি আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। উন্মুক্ত এ নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই স্থানীয় একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় নিজেদের মধ্যেই ঘটছে সংঘর্ষ-হামলা। একপক্ষ নানাভাবে চেষ্টা করছে অপরপক্ষকে কোণঠাসা করার। হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও উঠছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী বা প্রভাবশালী নেতারা প্রকাশ্যে বা মৌন সমর্থন দিচ্ছেন পছন্দের প্রার্থীর প্রতি। নির্দেশনা অমান্য করে অনেকেই মাঠে রেখেছেন পরিবারের সদস্যকেও। অনেক প্রার্থী আবার নিজেকে দাবি করছেন এমপি বা দল সমর্থিত হিসাবেও। সভা-সমাবেশে উসকানি বা উত্তেজনামূলক বক্তব্যও দিচ্ছেন কেউ কেউ। এসব কারণে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। ফলে তৃণমূলের এই বিভক্তি নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি বলেন, আমরা এই বিষয়গুলো মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছি না। আমরা সব সময় চাই নির্বাচনের পরিবেশ সুন্দর থাকুক, ভালো থাকুক। এ ধরনের ঘটনাগুলো যেন না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের দলের নেতাকর্মীসহ সবাইকে ইতোমধ্যে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। যারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। দলীয় সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলে যে দ্বৈরথ তৈরি হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়তে পারে বলে আওয়ামী লীগের আশঙ্কা। ফলে সংসদ নির্বাচনের মতো নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে তৈরি হওয়া সংঘাতময় পরিস্থিতি এবার এড়াতে চাইছে দলটি। তবে মাঠের চিত্র বলছে উলটো কথা। এছাড়া নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবমুক্ত রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটে না থাকার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। তবে এ নির্দেশনা মানেননি বেশিরভাগ এমপি-মন্ত্রীই। নানা যুক্তি দেখিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছেন তারা। বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও। এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতেই মন্ত্রী-এমপির পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ সময় পরিবার বলতে তিনি ‘নিজে (মন্ত্রী বা এমপি), তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে’ বুঝিয়েছেন বলেও ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, প্রভাবমুক্ত রেখে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। সেক্ষেত্রে যারাই জিতে আসে আসুক, মানুষ যাকে চাইবে সে-ই আসবে। একইদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় দলীয় সংসদ সদস্যদের সতর্ক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এমপিদের প্রভাব বিস্তার না করার নির্দেশ দিয়ে তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনে যেন কোনো সমস্যা না হয়। নির্বাচনটা যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হয় সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমি স্বতন্ত্র সদস্যদের সঙ্গেও বসব, তাদের সঙ্গেও কথা বলব। এ সময় পরিবারের সদস্যদের সব জায়গায় না রেখে দলের নেতাকর্মীদের সুযোগ দেওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা যে একেবারেই ঘটবে না সেটা বলা যায় না। আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছি, যাতে করে সহিংসতা, মারামারি-এসব বিষয় কমিয়ে আনা যায়। এদিকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলটির সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল চাইছেন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে। এছাড়া বিএনপির বর্জন ও নেতিবাচক প্রচারণার পরও নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক রাখতে চায় দলটি। একই সঙ্গে নির্বাচনে যেন কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে ব্যাপারে শুরু থেকেই কঠোর দলটি। এ বিষয়ে দলীয় সংসদ সদস্যদের একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছে। বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা জানানো হয়েছে প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদেরও। তবুও থেমে নেই হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। নির্বাচনি বিরোধের জেরে প্রচারণার সময় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলমকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের অভিযোগ উঠেছে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পশ্চিম মহেশখালীয়াপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বদির স্ত্রী শাহিন আক্তার বর্তমানে সেখানকার স্থানীয় সংসদ সদস্য। নুরুল আলম এবারও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করছেন। তার দাবি-সাবেক এমপি বদি ও জাফর চেয়ারম্যানসহ ২০-৩০ জন লোক আমাদের পাশে এসে সমাগম লক্ষ করে দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। এছাড়া ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন দিনে বিভিন্ন স্থানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় ৩৩ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় পুলিশ আটজনকে গ্রেফতার করেছে। পাবনার সুজানগরে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৪ পুলিশসহ ১২ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২ জন গুলিবিদ্ধ। মাদারীপুরে প্রতিপক্ষের দুই কর্মীকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। মাগুরার শ্রীপুরে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। দিনাজপুরের বিরামপুর ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে সহিংসতায় একজন আহত এবং প্রতিপক্ষের পোস্টার ছেঁড়া, প্রচারে বাধা ও নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকির অভিযোগ পাওয়া গেছে।