পণ্যের বাড়তি দামে ভোগ্যপণ্যের বাজারে নিুবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্তদেরও নাভিশ্বাস অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক থাকলেও কারসাজি করে বাড়ানো হয়েছে আলুর দাম। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে এক কেজি আলু কিনতে ক্রেতাকে ৫০-৫৫ টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যা ১ মাস আগে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। পাশাপাশি অবৈধ মজুত করে অস্থির করা হয়েছে ডিমের বাজার। প্রতি ডজন ডিম কিনতে ভোক্তার গুনতে হচ্ছে ১৫০ টাকা। যা কয়েকদিন আগেও ১২০ টাকা ছিল। সঙ্গে ডালের কেজি এই মুহূর্তে ১৩৫ টাকা, যা কয়েক মাস ধরেই এই মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কেজিপ্রতি ৬০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি। নতুন করে মোটা চালের দামও কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গরিবের খাবারের তালিকায় এখন চাল, ডাল-আলু ভর্তা ও ডিমের জোগানেও একরকম গলদঘর্ম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে তদারকির অভাবে তেল, চিনি, আটা, ময়দার দাম বেড়ে গেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে কুরবানির ঈদ ঘিরে বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের মসলা পণ্যের দাম। সঙ্গে উচ্চ মূল্য হওয়ায় মাছ-মাংসের কাছে ঘেঁষতে পারছে না নিুআয়ের অনেকে। এতে অনেক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পরিবারের জন্য বাজার করা বড় ধরনের মানসিক কষ্ট ও হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরান বাজার, মালিবাগ বাজার, নয়াবাজার ও শান্তিনগরসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি ডজন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যা ৭ দিন আগেও ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সাদা ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা। যা ৭ দিন আগে ১১০-১২০ টাকা ছিল। সেক্ষেত্রে সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনপ্রতি বাদামি ও সাদা ডিমের দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। এদিকে ডিমের বাজার অস্থিরতার পেছনে অবৈধ মজুতের প্রমাণ পেয়েছে সরকারের বিভিন্ন তদারকি সংস্থা। অভিযানে দেখা যায়, কোল্ড স্টোরেজে বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের ডিম মজুত আছে। যা প্রায় ২০ দিন হতে ১ মাস আগেই কোল্ড স্টোরেজে মজুত করা হয়েছে। তবে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সতর্ক করে দায় সেরেছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা বিক্রি হলেও আগে ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ টাকা। আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯০০-১১০০ টাকা। এদিকে প্রতি কেজি আলু খুচরা বাজারে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ১ মাস আগে ৪০-৪৫ টাকা ছিল। আর গত বছর একই সময় কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩০-৩৫ টাকা। সরকারি সংস্থা সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ হয়েছে ১৩ টাকা ৯০ পয়সা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মতে, বাজারে যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। সঙ্গে প্রতি কেজি ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। গরিবের মোটা চাল কিনতে একজন ক্রেতার গুনতে হচ্ছে ৫৫ টাকা। যা ১ মাস আগেও ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রাজধানীর নয়াবাজারে কথা হয় দিনমজুর মো. ডালিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ভ্যানগাড়িতে মালামাল বহন করে ৫০০-৬০০ টাকা ইনকাম করি। এই টাকা দিয়ে পরিবারের মা-বাবা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মিলে ছয়জনের জন্য বাজার করতে হয়। পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য খরচ বহন করতে হয়। তবে বাজারে পণ্যের যে দাম তা দিয়ে কিছুই কিনতে পারি না। এ জন্য ইচ্ছা করেই পণ্য কম কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ডাল, ডিম, আলু দিয়ে আগে দুইবেলা পার করতাম। এখন দাম বেশি হওয়ায় কী দিয়ে কী কিনব তা ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সার্বিক কারণে এমনিতেই নিুআয়ের মানুষ কষ্টের মধ্যে আছে। এর মধ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে একাধিক পণ্যের দাম হুহু করে বাড়ছে। এতে উচ্চশ্রেণির মানুষের ভোগান্তি না হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিুআয়ের মানুষ। যারা তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় তা দিয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে কেনার সময় অনেকে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে, বাজারে তদারকি জোরদার করে অসাধুদের আইনের আওতায় আনা। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা। যা এক মাস আগেও ৬০-৬৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি দেশি রসুন ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ১ মাস আগে ১৫০ টাকা ছিল। হলুদ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি। যা এক মাস আগে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দুই মাস আগে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হয়েছে ২২০০-২৪০০ টাকা। বৃহস্পতিবার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪২০০ টাকা। পাশাপাশি গত সপ্তাহে প্রতি কেজি পটোল ৫০ টাকায় বিক্রি হলেও বৃহস্পতিবার ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি বরবটি ৭০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৪০, পেঁপে ৮০ টাকা, ঝিঙ্গা ৬০, করলা ৬০, কাঁকরোল ১০০-১২০ টাকা, কচুমুখী ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি এক ফালি মিষ্টি কুমড়া ৩০ টাকা, প্রতি পিস লাউ ৪০ টাকা, প্রতি পিস চাল কুমড়া ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি লম্বা বেগুন ১২০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১৬০, গাজর ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি পিস ফুলকপি ৬০ টাকা ও প্রতি পিস বাঁধাকপি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সাবির্ক ভাবে পণ্যের দাম সহনীয় করতে তদারকি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি কুরবানির ঈদ ঘিরে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। কোনো অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। হিমাগারে লাখ লাখ ডিম মজুত : টেকেরহাট (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, হিমাগারে থাকার কথা আলু, কিন্তু সেখানে এখন মজুত লাখ লাখ ডিম। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে, সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম হালিতে বাড়ানো হয়েছে ১২-১৫ টাকা। মাদারীপুর জেলাজুড়ে শুধু দুজন বড় ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি ডিমের বাজার। এতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। মাদারীপুর কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল করিম বলেন, দুই ব্যবসায়ীর প্রায় ৬ লাখ ডিম হিমাগারে মজুত রয়েছে। তারা মার্চ থেকে ডিম মজুত রেখেছেন। সুবিধামতো ব্যবসায়ী দুজন ডিম বাজারে আস্তে আস্তে ছাড়েন। ডিম ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাস হিমাগারে ভালো থাকে। এর বেশি দিন হলে ডিম পচে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাদারীপুরের সহকারী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, অবৈধভাবে মজুত রেখে ডিমের দাম বাড়ানোটা অযৌক্তিক। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসাধুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বগুড়ায় কোল্ড স্টোরেজে পাঁচ লাখ ডিম মজুত : বগুড়া ব্যুরো জানায়, বগুড়ায় গত কয়েকদিন ধরে ডিমের বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করায় ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এক সপ্তাহে প্রতি পিস ডিমের দাম ২-৩ টাকা বাড়িয়েছে। এ অবস্থায় কাহালুর মুরইলে আফরিন কোল্ড স্টোরেজ নামে হিমাগারে প্রায় পাঁচ লাখ ডিমের সন্ধান পাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মেরিনা আফরোজের ভ্রাম্যমাণ আদালত বুধবার বিকালে সেখানে অভিযান চালিয়ে মালিককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এছাড়া ডিমগুলো বিক্রি করতে এক সপ্তাহের সময় দেন।