রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা বা ১০১ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে বকেয়া ছিল ৭৬ হাজার কোটি ডলার বা ৮৩৬০ কোটি টাকা। তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ডলারের হিসাবে বকেয়া বেড়েছে ২৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রার হিসাবে বেড়েছে ২৯৫০ কোটি টাকা। ডলার সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কমিয়ে দেওয়ায় এবং কিছু খাতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে বকেয়া স্থিতি বেড়ে গেছে। সূত্র জানায়, ৯ মে এক দিনে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। ফলে ডলারের দাম বেড়ে ১১৮ টাকা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। ওই হিসাবে বকেয়া স্থিতি ছিল ১১ হাজার ১১০ কোটি টাকা। ডলারের দাম বাঁড়ার কারণে এখন তা বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। ওই সময়ে বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় বেড়েছে ৮৯০ কোটি টাকা। এসব দেনা বাজার থেকে ডলার কিনে পরিশোধ করতে হবে। আগের বকেয়া দায় এখন পরিশোধ করলে ডলারের দাম বাড়ার কারণে ৮৯০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া ওই দামে এখন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকের এমডিরা যুক্তরাষ্ট্র সফরের খরচ বাবদ ডলার কিনেছেন ১২৩ টাকা করে। অর্থাৎ নির্ধারিত দামের চেয়ে ৫ টাকা বেশি। ফলে দায় পরিশোধ করতেও গ্রাহকদের বাড়তি দামেই ডলার কিনতে হবে। এতে দায় পরিশোধের মাত্রা আরও বেশি হবে। এই দামে ডলার কিনতে হলে পরিশোধ করতে হবে ১২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ১২৫ টাকার কমে আমদানিতে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সরকারি খাতের আমদানির দায় ১১৮ টাকা করে পরিশোধ করা হচ্ছে। তবে সরকারি অন্যান্য সংস্থার দায় যেমন জ্বালানি তেল বা গ্যাস আমদানির দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের ১২৫ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। রপ্তানি আয় দেশে আসার পর ওই দায় সমন্বয় করা হয়। লোকাল কিছু এলসির মাধ্যমেও দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। আগে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির কোনো দায় বকেয়া থাকত না। রপ্তানির আয় দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওই দায় শোধ করা হতো। ফলে এ খাতে কোনো বকেয়া থাকত না। কিন্তু করোনার সময় বৈশ্বিক লকডাউনের কারণে এ খাতের দায় সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে বকেয়া জমেছে। এ দায় আগে অল্প পরিমাণেই ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে এ দায় বাড়তেই থাকে। করোনার সময়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির বকেয়া ছিল ৯৪ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৭ কোটি ডলারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দায় পরিশোধের কারণে ৮৫ কোটি ডলারে নেমে আসে। ডলার সংকট মোকাবিলা করতে ওইসব ঋণের কিস্তি স্থগিত করায় ও নতুন এলসি খোলার প্রবণতা বাড়ায় বকেয়া দায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১ কোটি ডলারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে বকেয়া দায় ছিল ৯০ কোটি ডলার। গত বছরের মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৭৭ কোটি ডলারে। জুনে আবার কিছুটা বেড়ে এ খাতে বকেয়া স্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে তা আবার কিছুটা কমে ৭৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ডিসেম্বরে তা আবার বেড়ে ১০১ কোটি ডলারে ওঠে। এদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগে এ খাতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল। আমদানি কমেছে ১৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আগে এ খাতে এলসি খোলা কম হওয়ায় এখন আমদানিও কম হচ্ছে। ঋণ করে কাঁচামাল এনে পণ্য রপ্তানির আয় দেশে আসছে না। ফলে এ খাতে সংকট আরও বাড়ছে। গত অর্থবছর স্বল্পমেয়াদি মূল ঋণ বাবদ ২৬৭ কোটি ডলার ও সুদ বাবদ ৯৪ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। দুই খাতে ৩৬১ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের মার্চে পরিশোধ করা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার। ডলার সংকটের কারণে দফায় দফায় স্বল্পমেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে ডলারের পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বাড়ায় সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের অঙ্কও বেড়েছে। এছাড়া দেশে ডলারের দাম বাড়ায় বাড়তি টাকা দিয়ে ডলার কিনে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। এতে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করায় রিজার্ভের হয়তো সাময়িক উপশম হয়েছে, কিন্তু দেশের বৈদেশিক দায় বেড়েছে তিন দিক থেকে। ঋণের অঙ্ক, সুদহার ও ডলারের দাম বৃদ্ধি। ফলে ঋণগ্রহীতাদের এখন তিন দিক থেকে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব কারণে ডলারের ওপর যেমন চাপ বাড়ছে, তেমনি এখন নতুন করে টাকার ওপরও চাপ বাড়ছে। কারণ ব্যাংকগুলোতে যথেষ্ট তারল্য নেই। ফলে তারা গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আওতায় বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্যে যেমন লাগাম টানা হয়েছে তেমনি সুদের হার বাড়িয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমানো হয়েছে।