ঢাকার আদালতে এক আসামির অনুপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি ও জামিন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ৩০ এপ্রিল অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় আসামি এজাজুল হকের বিষয়ে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট দুই ধরনের আদেশ দিয়েছেন। এ নিয়ে চলছে শোরগোল। আইনজীবীরা নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আইনজীবীদের দাবি, আসামির অনুপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি করে জামিন দেওয়া স্বাভাবিক বিষয় মনে হয় না। এক্ষেত্রে আদালত নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। তারা আসামির অনুপস্থিতিতে আদেশ বা শুনানি প্রকাশ্যে করে খাস কামরায় আদেশ নিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ও হাইকোর্টের আদেশ সামনে রেখে তাদের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। সাইফুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র; ৫৬ ডিএলআর (২০০৪) ৩২৪ এর আদেশে হাইকোর্ট বলেছেন, আসামির উপস্থিতিতে রিমান্ড আদেশ দেওয়া সমীচীন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় বলা আছে, ‘আসামিকে পুলিশ হেফাজতে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা এ বিষয়ে আদেশ দেওয়ার পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেটকে কেস ডায়েরিসহ আনুষঙ্গিক তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে দেওয়া সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই বিচারিক মনোভাব পোষণ করবেন। যদি দেখা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক মনোভাব পোষণ করেছেন, তবেই তার প্রদত্ত আসামিকে পুলিশ হেফাজতে দেওয়ার আদেশ বৈধ বলে গণ্য হতে পারে।’ জানা যায়, ২৮ এপ্রিল আসামিপক্ষ অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় আসামি এজাজুল হকের জামিনের আবেদন করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিবের আদালতে এ জামিন শুনানির জন্য ৩০ এপ্রিল ধার্য রাখা হয়। বাদীর উপস্থিতিতে ওইদিন জামিন শুনানি হবে বলে (২৮ এপ্রিল) আদেশ দেওয়া হয়। এরমধ্যে ২৯ এপ্রিল আসামির রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিবের আদালতের ৩০ এপ্রিল জামিন শুনানির আদেশ বহাল থাকা অবস্থায় ৩০ এপ্রিল সকালে তদন্ত কর্মকর্তার রিমান্ড আবেদনের ওপর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান শুনানি শেষে একটি আদেশ জারি করেন। এদিন আসামি এজাজুল হক জেলহাজত থেকে আনা হয়নি উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট (আসামিকে আদালত থেকে আনা) জারি করেন তিনি। আসামি এজাজুল হকের উপস্থিতিতে ৫ মে রিমান্ড শুনানি হবে মর্মে তিনি আদেশে উল্লেখ করেন। এদিকে ৩০ এপ্রিলের আরেক আদেশে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান বলেন, আসামি ২৫ এপ্রিল আটক হলেও কেন ২৯ এপ্রিল রিমান্ডের আবেদন করা হলো-তদন্ত কর্মকর্তা সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেবেন। এছাড়া জামিন শুনানি পেন্ডিং থাকার কথা না জানিয়ে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু করার জন্য স্বাক্ষর নেওয়ায় জিআরও-কে (কোর্টে ফৌজদারি মামলার রেকর্ড পুলিশের যে অফিসারের জিম্মায় থাকে) ৮ মের মধ্যে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আসামির প্রডাকশন ওয়ারেন্ট বাতিল করেন। আবার এদিন বিকালেই ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিবের আদালত আসামির অনুপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি করেন। শুনানি শেষে ওদিনই রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। এছাড়া আসামি এজাজুলের জামিনও মঞ্জুর করা হয়। আদেশে ম্যাজিস্ট্রেট উল্লেখ করেন, ‘বাদী আসামির নিকট তার দাবিকৃত ১৫ কোটি টাকার চেক নিয়েছেন এবং ডিজ-অনার করিয়েছেন। সার্বিক দিক পর্যালোচনায় বাদী ও আসামির মধ্যেকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা এবং স্বীকৃতমতে বাদীর দাবিকৃত ১৫ কোটির বিপরীতে আসামির কাছ থেকে চেক নিয়েছেন বিধায়-সার্বিক দিক বিবেচনায় ১০ হাজার টাকা বন্ডে বিজ্ঞ কৌঁসুলি ও দুজন স্থানীয় ব্যক্তির জিম্মায় ধার্য তারিখ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হলো।’ আদেশে আরও বলা হয়, আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) কর্তৃক ৭ দিনের রিমান্ডের যৌক্তিক কারণ প্রতীয়মান না হওয়ায় রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করা হলো।’ আইনজীবীরা জানান, এভাবে দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের একদিনে তিন ধরনের আদেশ নিয়ে আমরা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যাই। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, বাদী যোসেফ গনসালভেস বিবাদী এজাজুল হককে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করার জন্য একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৫ কোটি টাকা প্রদান করেন। সম্প্রতি কাজের যথেষ্ট অগ্রগতি না হওয়ায় তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে টাকা উদ্ধারের জন্য তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন। ২৪ এপ্রিল মামলার আসামি মো. এজাজুল হককে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এ মামলায় লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ নিশ্চিত করাসহ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বাস্তবচিত্র জানার জন্য তদন্ত চলমান রয়েছে। মামলার তদন্তের প্রয়োজনে পরে রিমান্ড আবেদন করা হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের সিটিটিসির পরিদর্শক আবুল বাসার যুগান্তরকে বলেন, আমি ২৯ এপ্রিল রিমান্ড আবেদন করি। পরে ৩০ এপ্রিল আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে জামিন দেন। কেন রিমান্ড চেয়েছি আদেশের ৪ দিন পর আমাকে শোকজ করা হয়। আমি তার জবাব দিয়েছি। আসামির অনুপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি হয় কিনা জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এমনিতে সচরাচর আসামির অনুপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি হয় না। তবে এটা আদালতের এখতিয়ার। আদালতের ওপরে তো আমরা না। আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ আলম যুগান্তরকে বলেন, আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর দেখতে পাই, ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে শোকজ করেছেন। কেন তিনি ৪ দিন পর রিমান্ড আবেদন করলেন তা জানতে চেয়েছেন। আদালত পিডব্লিউ (প্রডাকশন ওয়ারেন্ট) বাতিল করলেন কিন্তু রিমান্ডের আবেদন বাতিল করেননি। আমার কাছে মনে হয় এটা একটা অস্বাভাবিক বিষয়। কোর্ট এজলাস থেকে একটা সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরে সেই সিদ্ধান্ত আবার পরিবর্তন করা। একই দিনে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। একজন লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন, আরেকজন মৌখিকভাবে আমাদের বলেছেন, রিমান্ড আবেদন থাকায় শুনানি করবেন না। পরে তিনি আসামির অনুপস্থিতিতে শুনানি করে রিমান্ড নামঞ্জুর করেন এবং জামিন দেন। আদেশে এমন কিছু নেই যে, উনাকে কেউ নির্দেশনা দিয়েছেন তাই শুনানি করবেন। আসামির অনুপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানির বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী সামসুজ্জোহা যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আদালত জানেন। অনেক সময় আদালত রিমান্ড শুনানি করে ফেলেন। এটা আদালতের এখতিয়ার। আদালত যখন বললেন এখন রিমান্ড শুনানি হবে, জামিন শুনানি হবে না। তখন আমরা চলে যাই। পরে আদালতই আমাদের ডেকে নিয়ে এসেছেন জামিন শুনানির জন্য।