চাকরি বা ব্যবসা কিছু নেই, পেশায় গৃহিণী। সঙ্গত কারণেই নেই আয়ের উৎস। আয়-রোজগার না থাকলেও খোদ ঢাকায়ই তিনি ১০টি প্লটের মালিক। এছাড়া আছে ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসহ নগদ কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ভাগ্যবান এই নারী আলোচিত কারবারি মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ লুকাতে স্ত্রীকে মালিক বানিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। অসাধু উপায়ে অর্জিত ও জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলে রাখার অপরাধে রওশন আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একইভাবে আলোচিত বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর অপরাধলব্ধ আয় ভোগ করতে গিয়ে মানি লন্ডারিং মামলার আসামি হয়েছেন তার স্ত্রী শিরিন আক্তার ও ছেলে শেখ রাফা হাই। তদন্ত শেষে বাচ্চুর সঙ্গে তাদেরও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। শুধু বাচ্চু কিংবা গোল্ডেন মনির নয়, ‘দুর্নীতিবাজ’ ব্যক্তিরা তাদের অবৈধ আয় বৈধ করতে স্ত্রী-সন্তানদের নামে সম্পদ গড়েন। গত বছর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে দুদক যেসব মামলা করেছে তাতে দেখা গেছে, শতকরা ৮০ জনই নিজের চেয়ে স্ত্রী-সন্তানের নামে বেশি সম্পদ কিনেছেন। কিন্তু দুদকের মামলায় তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। ফলে অনেক স্ত্রী-সন্তান এখন অভিভাবকের অবৈধ আয় দিয়ে নিজেদের নামে সম্পদ গড়তে অনীহা দেখাচ্ছে। যেসব স্ত্রী স্বামীর অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন কিন্তু এখনো নাম প্রকাশ হয়নি, তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে কোনো সময় সব ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় তাদের গ্রাস করছে। পিতা বা অভিভাবকের অপকর্মের দায়ে সামাজিকভাবে অপমানিত হওয়ার শঙ্কা ভর করছে সন্তানসহ স্বজনদের মাঝে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রসঙ্গত, সাবেক মহাপুলিশ পরিদর্শক বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও সম্পদের খোঁজে নেমে বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন দুদক কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রেও বেনজীরের চেয়ে তার স্ত্রী জিসান মির্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিস্তা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে তাহসিনা রাইসা বিনতে বেনজীরের নামেই বেশি সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। তাদের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন বেনজীর। এছাড়া তাদের নামে বাড়ি-জমি-ফ্ল্যাটও কিনেছেন তিনি। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তি না হওয়ার কারণে তারা বহুমাত্রিক অপরাধে জড়াচ্ছেন। একটা হচ্ছে-নিজে দুর্নীতি করছেন, সেটা একটা অপরাধ। এর দায় স্ত্রী-সন্তানদের কাঁধে চাপাচ্ছেন। এতে করে তাদেরও দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলা হচ্ছে। নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতেই স্ত্রী-সন্তানের ঘাড়ে দায়টা চাপানো হয়। এটা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির দ্বিতীয় মাত্রার অপরাধ। অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানরা সচেতনতার অভাবে না জেনে এই দায় বহন করে। তৃতীয় হচ্ছে-অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানরা সামাজিক অবস্থা দেখে অভিভাবককে দুর্নীতি করতে প্ররোচিত করে। চতুর্থত-স্বামী-স্ত্রী উভয়পক্ষ যোগসাজশে দুর্নীতি করে।’ প্রথমেই শাস্তি হলে বাকি ধাপগুলো দেখতে হতো না। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির ডালপালা ছড়ানোর অংশ হিসাবেই তা পরিবার পর্যায়ে শেকড় গেড়েছে। তবে দুর্নীতি বন্ধে পরিবার থেকেই প্রতিবাদ শুরু হওয়া উচিত। পরিবারের যিনি উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বৈধ আয়ের দিকে খেয়াল রেখেই অন্য সদস্যদের জীবনমান সাজালে কোনো সমস্যা হওয়া কথা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা না করে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর বাড়তি চাপ দেওয়ার ফলে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপার্জনের পথে পা বাড়ায়। এক পর্যায়ে তা ব্যাপক আকার ধারণ করলে দুর্নীতিলব্ধ আয় বৈধ করতে তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নামে সম্পত্তি কেনেন। স্ত্রী-সন্তানরাও এটার বিরোধিতা না করে ভোগ করেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দুদক কঠোর ব্যবস্থা নিতে থাকলে এই প্রবণতা কমবে।’ জানা গেছে, বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীই দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ গড়েন বেশি। তালিকায় পরের কাতারেই আছে রাজনীতিবিদদের নাম। এক্ষেত্রে তারা অবৈধ আয় আড়াল করতে কিংবা কৌশলে বৈধতা দিতে নিজেদের চেয়ে স্ত্রী-সন্তান কিংবা স্বজনদের নামে সম্পদ কেনেন বেশি। অনেকেই আবার কূটকৌশল হিসাবে স্ত্রী-সন্তানের নামে কাগুজে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে সেখানে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান ও মামলা তদন্তের ধারা এমন যে, নামে-বেনামে লুকানো সম্পদও তারা বের করে আনেন। ফলে অন্যের নামে সম্পদ করেও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা তো পার পাচ্ছেনই না, সঙ্গে ফাঁসছেন তাদের স্ত্রী-সন্তানও। আলোচিত প্রায় সব দুর্নীতির মামলায়ই দেখা গেছে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু তাকে ঘিরে অনুসন্ধান শুরুর পর স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামও চলে আসে। অনুসন্ধান শেষে মামলায় তাদেরও আসামি করা হয়। দুদকের উপপরিচালক পদমর্যাদার এক অনুসন্ধান কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সবার সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। কারণ অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত এমনভাবে হয় তাতে বেনামে সম্পদ করেও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। তদন্তের সময় বৈধ আয়ের উৎসের সঙ্গে সবার সম্পদের তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়। এজন্য অবৈধ আয় গোপন করতে স্ত্রী-সন্তানদের নামে সম্পত্তি করে কোনো লাভ নেই। এগুলোও আইনের আওতায় চলে আসে। ফলে তদন্ত বা অনুসন্ধানকালে এই সম্পদ ঘিরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশও দেখা গেছে। গত বছর দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সরকারের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সাবেক নিয়ন্ত্রক মুন্সী রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু পুরো সম্পদই করেছেন গৃহিণী স্ত্রী কানিজ ফাতেমার নামে। ফলে এই দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে ফেঁসে গেছেন তার স্ত্রী খাইরুন নেসা। এই দম্পতির বিরুদ্ধেও মামলা করেছে দুদক। সার্ভেয়ার স্বামী আবুল হোসেনের কামানো টাকায় কোটিপতি হয়ে দুদকের মামলায় ফেঁসেছেন তার গৃহিণী স্ত্রী আফরোজা বেগম চায়না। স্বামী-স্ত্রী দুজনই এখন দুদকের মামলার আসামি। সিনিয়র জেল সুপার শাজাহান আহমেদ অবৈধ আয় দিয়ে তার গৃহিণী স্ত্রী নূরুন্নাহার লোটাসের নামে বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট কেনেন। স্বামীর অবৈধ টাকায় নিজের নামে এসব সম্পদ করে ফেঁসে যান তিনি। এই দম্পতির বিরুদ্ধেও মামলা করেছে দুদক। হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের মামলার পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, স্বামীর দুর্নীতির দায়ে ফেঁসেছেন স্ত্রী। স্বামীর অপরাধলব্ধ সম্পদ আড়ালে সহযোগিতা করতে গিয়ে স্ত্রীদের কারাবাসের নজিরও রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের অপকর্মের দায়ে কারাবিন্দ হন তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম। ই-ভ্যালি কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে স্বামী রাসেলের অপরাধের দায়ে জেল খাটতে হয়েছে স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে। করোনাকালে জেকেজি হেলথ কেয়ার দুর্নীতিতে স্বামী আরিফুল ইসলামের সঙ্গে ফেঁসে দীর্ঘ হাজতবাস করে জামিনে মুক্তি পান স্ত্রী ডা. সাবরিনা চৌধুরী।