বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আন্তঃব্যাংক বা এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের লেনদেন আবার কমে গেছে। জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সম্পাদিত আন্তঃব্যাংক লেনদেন কমেছে ১ লাখ ১১ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন বেড়েছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে কমেছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসে লেনদেনের ওঠানামা থাকলেও গড়ে লেনদেন কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যাংক খাতের আন্তঃব্যাংক লেনদেনের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এর কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক থেকে ধার করার প্রবণতা কমিয়েছে। গ্রাহকরা যেসব লেনদেন করছেন সেগুলো আন্তঃব্যাংককেন্দ্রিক কম। এছাড়া ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগের ফলে এ খাতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এ কারণেও গ্রাহকরা দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন কমিয়ে সবল ব্যাংকে লেনদেন করছেন। এছাড়া সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে টাকার প্রবাহ কমায় আন্তঃব্যাংক লেনদেন কম হচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে, এ কারণে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন কমেছে। এসব কারণে আন্তঃব্যাংক লেনদেন কমে গেছে। এ লেনদেন কমা মানেই হচ্ছে ব্যাংক খাত সুষমভাবে এগোচ্ছে না। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এতে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে চাপ আরও বাড়বে। আন্তঃব্যাংকে লেনদেন একটি ছন্দের মধ্যে থাকার কথা, সেটি না থেকে বড় ধরনের হ্রাস বৃদ্ধি ব্যাংক খাতের অস্থিরতাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে গ্রাহকরা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে যাচ্ছেন। ফলে গ্রাহকরা ব্যাংকের মধ্যেই থাকছেন, কিন্তু ব্যাংক বদল করছেন। এতে সব ব্যাংকগুলোতে লেনদেন বেশি হচ্ছে। যে কারণে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন কমেছে। এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, জানুয়ারিতে সব ব্যাংকগুলোর আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করেছিল ৭ লাখ ১৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে লেনদেন করেছে ৬ লাখ ৩ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে লেনদেন কমেছে ১ লাখ ১১ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সব ধরনের ব্যাংকেই আন্তঃব্যাংক লেনদেন কমেছে। তবে গ্রাহকরা আন্তঃব্যাংকে লেনদেন কমিয়ে এটিএম বুথের মাধ্যমে বেশি সেবা নিচ্ছেন। যে কারণে এটিএম বুথের মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাচ্ছে। তবে যে হারে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন কমেছে সে হারে এটিএম বুথের মাধ্যমে লেনদেন বাড়েনি। এদিকে বিভিন্ন ধরনের কার্ডের মাধ্যমেও লেনদেন কমে গেছে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো জানুয়ারিতে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করেছিল ৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে লেনদেন কমেছে ৯৯ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করেছিল ৯০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে লেনদেন হয়েছে ৭৮ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে লেনদেন কমেছে ১১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে লেনদেন বেড়েছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর আগে নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে লেনদেন কমেছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সাধারণত আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করে না। ১০টি পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে তারা নিজেদের মধ্যে আন্তঃব্যাংক লেনদেন করে। কিছু ইসলামী ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ায় আন্তঃব্যাংকে লেনদেন কমেছে। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের কার্ডে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন কমেছে ৯৭২ কোটি টাকা। তবে এটিএম মেশিনের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে। এদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়ন কমে গেছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ৯ হাজার ৮৭১ কোটি টাকার। এক মাসের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। যদিও সামগ্রিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। একটি ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না বলে সামগ্রিকভাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জানুয়ারিতে রপ্তানি আয় এসেছিল ৭ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ৬ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৬৩৯ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে সামগ্রিকভাবে রপ্তানি আয়ও সামান্য কমেছে। জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো আমদানি বাণিজ্যে অর্থায়ন করেছিল ১২ হাজার ২০২ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে অর্থায়ন দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকায়। আলোচ্য এ মাসে এ খাতে অর্থায়ন কমেছে ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ওই সময়ে সমগ্রিকভাবে আমদানিও কমেছে। ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ও সম্পদের পরিমাণ কমলেও জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে আমানত বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতেও আমানত বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সম্পদের পরিমাণ।