গাফিলতির শিকার ৩১ হাজার কর্মী

প্রকাশিতঃ জুন ১, ২০২৪ | ৬:০৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, এজেন্সি ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতার কারণে প্রায় ৩১ হাজারের বেশি বৈধ শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার বাংলাদেশের কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশের ডেটলাইন ছিল। ভিসা থাকার পরও তারা টিকিট না পেয়ে মালয়েশিয়াগামী বিমানে উঠতে পারছেন না। ফলে চরম অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর উৎকণ্ঠায় কাটছে এসব কর্মীর দিন। ২০-৩০ হাজার টাকার বিমানের টিকিট লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই টিকিট এখন সোনার হরিণ। আগে যেখানে সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হতো সেখানে বর্তমানে ছয় লাখ টাকার বেশি ব্যয়ের পরও যাত্রা অনিশ্চিত । অভিযোগ আছে, বেশ কয়েকটি এজেন্সি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা নিয়েও কোনো টিকিট বা কাজের অনুমতিপত্র দিতে পারেনি। বিভিন্ন এজেন্সি ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুক্রবার দিনভর মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের হতাশা, উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা ছিল চরমে। অনেকেই টিকিট ছাড়াই ভিড় জমান সেখানে। এদের কেউ কেউ দু-তিন দিন আগে থেকেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে বসে আছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মীরা নিরাপদে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারলে তাদের জীবন যেমন অনিশ্চয়তায় ডুববে, তেমনি রেমিট্যান্স হারাবে দেশ। জানা গেছে, মালয়েশিয়ান সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটুট। তবে বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক দেশটিতে যেতে পারেননি তাদের পাঠানোর উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ সরকার। এদিকে জনশক্তি রপ্তানিকারক সংগঠন বায়রার দাবি করেছে, এজেন্সির পক্ষ থেকে সবকিছু করা হলেও দুর্বলতা আছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। তারা বলছেন, মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের জন্য বাড়তি ফ্লাইট পরিচালনা করা হলে বর্তমান এই সংকট তৈরি হতো না। বায়রা যুগ্মসচিব এম টিপু সুলতান বলেন, এক সপ্তাহ আগেও যদি মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা সাপেক্ষে প্রতিদিন ১০-২০টি চার্টার্ড ফ্লাইট দেওয়া যেত তাহলে আজকে কর্মীদের দুর্দশা লাঘব হতো। প্রায় ৩০ হাজার কর্মী যেতে পারছেন না, এটা বড় ক্ষতি। আমরা মনে করি, সরকার চাইলেই এ বিষয়ে আগে থেকেই আরও পদক্ষেপ নিতে পারত। তিনি বলেন, টিকিটের সিন্ডিকেটের কারণে ৩০ হাজার টাকার টিকিটের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে এখন দুই লাখ হয়ে যাচ্ছে। দায় আছে এসবেরও। এদিকে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও বিএমইটির তথ্য বলছে, মন্ত্রণালয় আরও এক হাজার ১১২ জন কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত চার লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে মাত্র পনেরশ কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন। সে হিসাবে, ভিসা ও অনুমোদন পাওয়ার পরও ৩১ হাজারের বেশি কর্মী নির্ধারিত সময়ে মালয়েশিয়া যেতে পারছেন না। এদিকে শুক্রবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে ঘিরে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের ভিড় ছিল। দেখা গেছে, এদের অনেকেই এজেন্সিতে টাকা জমা দিয়েছেন, ভিসা আছে। কিন্তু বিমানের টিকিট না পাওয়ায় তাদের মালয়েশিয়া যাওয়া অনিশ্চিত। অনেকে আবার আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে কিনেছেন টিকিট। মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের মধ্যে একজন বলেন, আগে টিকিটের দাম ছিল ২০ হাজার টাকা। এখন সেটা লাখ টাকার বেশি। বেশি টাকা দিয়েও টিকিট পাব তার নিশ্চয়তা নেই। টিকিটের জন্য ঘুরছি। আরেকজন বলেন, মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে বিষয়টা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিমান বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি বলে মনে করি। তাহলে অনেক আগে থেকেই আমাদের সেখানে পাঠানোর জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হতো। সেটা হয়নি বলেই এখন এ দশা। আর এর ফায়দা লুটছে টিকিট সিন্ডিকেটও। এজেন্সির কর্মকর্তা বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যে কোনোভাবে টিকিট সোর্সিং করে কর্মীদের পাঠাতে। যদিও টিকিটের দাম অনেক বেশি। চাহিদার তুলনায় ফ্লাইটও কম, এজন্যও দাম বেড়েছে টিকিটের। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মালয়েশিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়া যেতে পারবেন। টিকিট না পেয়ে বিমানবন্দরে বিক্ষোভ টিকিটবিহীন পাঁচ থেকে ছয় হাজার কর্মী বিক্ষোভ করছেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। শুক্রবার তাদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে দেখা গেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভিসা পাওয়া কর্মীদের আজকের মধ্যে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে হবে। এ কারণে শেষ দিন কর্মীরা বিমানবন্দরে ভিড় করছেন। টিকিট না পাওয়া আরও কয়েক হাজার কর্মী ভিড় করেছিলেন বিমানবন্দরের বাইরে। কিন্তু সন্ধ্যায় বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ২৭১ কর্মী যেতে পারলেও বাকিদের যাত্রা অনিশ্চিত। বিমানের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. আল মাসুদ খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বিমানের ব্যবস্থাপক মো. আল মাসুদ খান জানান, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কথা বিবেচনা করে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে একটি বিশেষ (অতিরিক্ত) ফ্লাইট পরিচালনা করবে। এই ফ্লাইটে ২৭১ জন যাত্রী পরিবহণ করা হবে। বিশেষ ফ্লাইটের ভাড়া জনপ্রতি ৭৩ হাজার ৬১৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে গেছে মালয়েশিয়াগামী তিনটি ফ্লাইট। রাত পর্যন্ত ছেড়ে যাবে আরও চারটি। এসব ফ্লাইটে যেতে পারবেন দেড় হাজার কর্মী। তবে কয়েকটি এয়ালাইন্স কর্তৃপক্ষ এই সংকট সামাল দিতে এই রুটে তাদের ফ্লাইট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুক্রবার বায়রার অনুরোধে পরিচালিত বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর গেছেন ২৭১ জন যাত্রী। এছাড়া আবেদনের ভিত্তিতে কম্বোডিয়া অ্যাংকর এয়ারকে এ রুটে চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেসরকারি ইউএস বাংলার পক্ষ থেকেও বাড়ানো হয়েছে ফ্লাইটের সংখ্যা। এভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে অভিযোগ আছে সরকার নির্ধারিত টাকার বেশি দামে টিকিট বিক্রি করে গত দুই সপ্তাহে একটি সিন্ডিকেট শতকোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা এবং বিদেশি আরও তিনটি এয়ারলাইন্স ও ট্রাভেল এজেন্সির কিছু অসাধু মালিক ও সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সিন্ডিকেট এই বাড়তি অর্থ কামিয়ে নিয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ২০ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়া পৌঁছানোর ঘোষণায় দেশি বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো তুঘলকি কায়দায় টিকিটের দাম বাড়ায়। শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছে, ২৫ হাজার টাকার টিকিট এক লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে। বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির নেতৃত্বে বিশেষ সিন্ডিকেট শ্রমিকদের জিম্মি করে রাতারাতি হাতিয়ে নিয়েছে শতকোটি টাকারও বেশি। বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী লে. কর্নেল অব. ফারুক খানও বলেছেন, চাহিদা বাড়লে সব জিনিসেরই দাম বাড়ে। বিমানের টিকিটেরও বেড়েছে। এটাই দুনিয়াব্যাপী রীতি। তবে সিন্ডিকেট নিয়ে মন্ত্রী কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা বক্তব্য দেননি। মন্ত্রী বলেন, বিমান ফ্লাইট সংখ্যা বাড়িয়েছে। বুধবার মালয়েশিয়ার কিছু লোক ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া রুটে এয়ার কম্বোডিয়ার একটি এয়ারক্রাফট দিয়ে চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়েছিল। আমরা অনুমতি দিয়েছি। আমার মনে হয় এটা পর্যাপ্ত। সর্বশেষ জানা গেছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে, মালয়েশিয়া প্রবাসী কর্মীদের কথা বিবেচনা করে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। জানা গেছে, গত ২০ মে থেকে হঠাৎ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার হিড়িক পড়ে। এতে ফ্লাইটের সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় অনেক প্রবাসীর মালয়েশিয়া যাওয়া নিয়ে দেখা দেয় শঙ্কা। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এই রুটে দৈনিক তিনটি এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দৈনিক দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্তের কারণে প্রবাসীদের টিকিটের প্রচুর চাহিদা বেড়েছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রবাসীদের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। শুধু মালয়েশিয়া নয়, প্রবাসীদের জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো রুটের ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো হবে। বিমানের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) আল মাসুদ খান জানান, এই রুটে বিমান গত চার দিনে নিয়মিত ফ্লাইটের পাশাপাশি অতিরিক্ত সাতটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ৩১ মে পর্যন্ত অতিরিক্ত ফ্লাইট চলবে। ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিমান সর্বনিম্ন ভাড়ায় প্রবাসীদের মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া টিকিটের চাহিদা বাড়ায় কম্বোডিয়ার সরকারি এয়ারলাইন্স কম্বোডিয়া অ্যাংকর এয়ারকে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া রুটে চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমানবন্দরে ভিড় করা ঢাকা দোহারের প্রবাসী ইসলাম বলেন, আমি অনেক আগে ভিসা পেয়েছি। গত ২৩ মে শুনলাম ৩১ তারিখের আগে ফিরতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখি ৪০ হাজার টাকার টিকিট নাকি এক লাখ টাকা। দাম কমবে এই আশায় অপেক্ষা করতে করতে আর টিকিট পেলাম না। শামীম নামে অপর এক যাত্রী জানান, তাদের এজেন্সি প্রথমে জানিয়েছিল টিকিটের দাম এক লাখ টাকা। পরে বলল কোনো এয়ারলাইন্সের সিট নেই। এক লাখ ২২ হাজার টাকা রেখেছে টিকিটের দাম। তিনি বলেন, গত মাসে হঠাৎ শুনলাম ৩১ তারিখের পর আর মালয়েশিয়ায় আমাদের ঢুকতে দেবে না। এতে সবার যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে টিকিট কিনেছি। বর্তমানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়ান এয়ারওয়েজ ও বাটিক এয়ার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অনেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে সিঙ্গাপুর হয়ে এবং থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক হয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। তার পরও অনেকেই টিকিট পাচ্ছেন না।