ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক

প্রকাশিতঃ জুন ১, ২০২৪ | ৮:৫৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে ধান বিক্রি করায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। দালাল, ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানেও তারা ধান বিক্রি করতে পারছে না। কমপক্ষে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারলেও তাদের লোকসান হতো না। প্রতি মন ধান বাজারভেদে কোথাও ৯৮০, কোথাও আবার ৯৫০, আবার কোথাও বিক্রি হচ্ছে ৮৯০ টাকা দরে। চলতি বছর সরকার প্রতি মন বোরো ধানের মূল্য নির্ধারণ করেছে এক হাজার ২৮০ টাকা। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের তরফ থেকে ধানের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করেছে। যে কারণে কৃষকরা সঠিক দাম পাচ্ছে না। মূলত সরকার ভুল পথে হাঁটছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কৃষক ধান চাষে নিরুৎসাহিত হবে। সরকারের ক্রয় অভিযান ব্যর্থ হবে। জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার বলেন, ধানের দাম কম বা কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করছে এটা আমার জানা নেই। তবে কৃষক ভেজা ধান সরাসরি বিক্রি করে দিচ্ছে। ভেজা থাকায় ধানের দাম কম পাচ্ছে। ১৪ শতাংশের বেশি আর্দ্রতা আছে এমন ধান সরকারই কেনে না। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, দালাল বা ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য আছে। তারা যোগসাজশ করে ধান চাল কেনে। কিন্তু ভেজা ধান ফড়িয়ারাও বেশি দামে কিনবে না। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ধান কাটার পর শুকিয়ে নিয়ে মাড়াইয়ের পর আরেকবার শুকিয়ে বিক্রি করলে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়। মন্ত্রী দাবি করেন, কৃষক এবং ভোক্তার কথা ভেবে সরকার দাম নির্ধারণ করে। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, প্রথমত ধানের দাম আরও বাড়িয়ে নির্ধারণ করা উচিত ছিল। সরকার নির্ধারিত মূল্য এক হাজার ২৮০ টাকা। সরকারি গুদাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে আরও ১৫০ টাকা খরচ হয় কৃষকের। সরকার হাট-বাজারে গিয়ে ওপেন মার্কেট থেকে ধান কিনলে কৃষক লাভবান হতো। সুতরাং সরকার নির্ধারিত মূল্য অনেক কম। তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সরকার প্রতিবারই ধান ও চাল কেনায় ব্যর্থ হয়েছে এবং এবারও হবে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, কৃষকের উৎপাদন খরচ সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি। কারণ ডিজেলের মূল্য, বিদ্যুৎ বিল, কীটনাশকের মূল্য, সারের মূল্য এবং কৃষকের শ্রমের মূল্য হিসাব করলে ধানের উৎপাদন মূল্যই অনেক বেশি পড়ে। আমরা বিগত বছরগুলোতে বলেছি এবং এখনো বলছি কৃষক বাঁচান। ধান চালের দাম আহরণের শুরুতে বাড়িয়ে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। কমপক্ষে আহরণ শুরুর প্রথম দেড় মাস বাড়িয়ে ক্রয় করুন। ভ্যানগাড়ি নিয়ে গ্রামের হাট-বাজার থেকে সরাসরি কিনুন। পর্যায়ক্রমে ধানের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তাহলে কৃষক কিছুটা লাভবান হবে। কিন্তু কেউ তা আমলেই নিচ্ছে না। আনোয়ার ফারুক বলেন, তৃতীয় বিষয় হচ্ছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে কৃষক একসময় ধান চাষে আগ্রহ হারাবে। যেমন- অব্যাহত লোকসানের কারণে অনেকে আলুর পরিবর্তে ভুট্টা চাষ করছে। বিকল্প ফসল হিসাবে অনেকে আম চাষ করছে। ফলে দেশে এখন আলুর জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। কারণ সরকার ভুল পথে হাঁটছে। বাজার অনুসন্ধান করে জানা গেছে, প্রকৃত কৃষকেরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছে না। দালালরা সিন্ডিকেট করে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারি ক্রয়কেন্দে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। এতে দালাল ফড়িয়াদের সহায়তা করছে খাদ্য বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা। কৃষদের জন্য বোরো ধানই মুখ্য। কারণ চাল বিক্রি করেন মিলাররা (চালকল মালিক)। চলতি বছর কৃষককে লাভবান করতে প্রতি কেজি ধানের মূল্য দুই টাকা বাড়িয়ে ৩২ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু কৃষকের জন্য সরকারের দেওয়া লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাচ্ছে। খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নানা অজুহাতে কৃষকদের আটকে দেওয়া হয়। কার্ডধারী কৃষকরা বিক্রয়কেন্দ্রে ধান নিয়ে গেলে বলা হয়, ধানে ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) বেশি ও ধানে চিটা সুতরাং কেনা হবে না। কৃষকের কাছে তো আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নেই। তখন কৃষক আবার ধান নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। এতে পরিবহণ খরচসহ হয়রানির শিকার হয় গরিব কৃষক। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে কৃষি কার্ড এবং ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকা বাধ্যতামূলক। বিক্রয়কেন্দ্রে ধান নিয়ে গেলে লটারি করা হয়। লটারিতে যাদের নাম আসে তাদের ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষা করা হয়। যদি আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হয় তাহলে ধান ক্রয় করে না। সেই ধানই দালালরা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি পর্যায়ে ধান কেনার যে প্রক্রিয়া তা বেশ জটিল। সেই জটিলতার সুযোগ নিয়েই সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। দালালরা প্রতি মন ধানে ২৯০ থেকে ৩৫০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অবৈধ লাভের ভাগ খাদ্য প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কৃষি কার্ড পেতেও রয়েছে জটিলতা। জমির মালিকানা না থাকলে কৃষি কার্ড দেওয়া হয় না। ফলে বর্গা চাষিরা কৃষি কার্ড পান না। চলতি মৌসুমে সরকারি কর্মচারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনার কথা থাকলেও বাড়ি না যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বরং বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে দালাল আর ফড়িয়ারা। কৃষকরা বাধ্য হয়ে তাদের কাছে ধান বিক্রি করে দিচ্ছে। সামর্থ্যবান কৃষকরা ধান ধরে রাখছে। যখন ধানের বাজার বেশি হবে তখন বিক্রি করবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দালাল এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ধান কেনাকাটার সিন্ডিকেট করে। যে কারণে প্রকৃত কৃষক সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছাতে পারে না। দালালদেরও কৃষি কার্ড আছে। দালালরা সংঘবদ্ধ হয়েই কাজ করে। এসব অপরাধ দেখাভাল করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। বাজারে প্রতি মন কাটারি ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৮০ থেকে এক হাজার টাকা। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচও উঠছে না। দিনাজপুর প্রতিনিধি একরাম তালুকদার জানান, বিআর-৮৮ জাতের এক মন ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকা। এতে লাভ দূরে থাক কৃষকের উৎপাদন খরচও উঠছে না। উল্লেখ্য, গত ৮ মে সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয় অভিযান উদ্বোধন করেন খাদ্যমন্ত্রী। চলতি অভিযানে সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে। এর মধ্যে ধান কেনা হবে পাঁচ লাখ টন। সেদ্ধ চাল ১১ লাখ টন এবং আতপ চাল কেনা হবে এক লাখ টন। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ক্রয় অভিযান চলবে। প্রতি কেজি বোরো ধানের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ধান ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকা। এছাড়া প্রতি মন এক হাজার ৩৬০ টাকা দরে ৫০ হাজার টন গম ক্রয় করবে সরকার।