মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে কিছুই পেল না সাধারণ মানুষ। কাগজ-কলমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিলেও কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে কমানো হবে সে বিষয়ে বক্তৃতায় বিস্তারিত বলেননি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তপূরণে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ভ্যাট-আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে ওইসব পণ্য ও সেবার দাম আরও বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও সংকুচিত করবে। প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে দেওয়া সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ এবং রাজস্ব নীতিতেও সহায়ক নীতি কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এসব নীতি কৌশলের ফলে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, কর জাল সম্প্রসারণ, কর আদায় ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অটোমেশন এবং হিউম্যান ইন্টারফেস (কর কর্মকর্তার সঙ্গে করদাতার যোগাযোগ) কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে নেওয়া রাজস্ব নীতিতে সহায়ক নীতিকৌশল বাজেট বক্তৃতার ভ্যাট, আয়কর ও আমদানি শুল্কের অধ্যায়ে থাকার কথা। সেই অধ্যায়ের শুরু হয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দিয়ে। শুরুতে বিত্তশালীদের ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু না থাকলেও পরের পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয়েছে পরতে পরতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হার বাড়ানোর রূপরেখা। ছোট-বড় সবার প্রিয় আইসক্রিমের সম্পূরক শুল্ক জের কাছে জনপ্রিয় পানীয়র দাম বাড়বে। এছাড়া সব ধরনের জুস, আমসত্ত (ম্যাংগো বার) উৎপাদনে ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে জুসের দাম বাড়বে। সিগারেট সম্পূরক শুল্ক প্রতিবছর বাড়ানো হয়, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বিধায় সিগারেটের দাম বাড়বে। মোবাইলে ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এখন কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। গ্রাহকরা ১০০ টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ কেটে নেওয়ার পর ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানোর ফলে গ্রাহকরা ১০০ টাকার মধ্যে ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার কথা বলতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে। চাকরির প্রয়োজনে অনেক মধ্যবিত্তের ফিটফাট হয়ে অফিস যেতে হয়। সেজন্য লন্ড্রিতে কাপড়চোপড় পরিষ্কার বা আয়রন করতে দেন। বাজেটে সেখানেও ভ্যাট হার ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ কাপড় ধোয়া ও আয়রন খরচ বাড়বে। অবসরে দেশের ভেতরে বিনোদন খোঁজে মধ্যবিত্ত। ঘুরতে যায় পার্কে। বাজেটে পার্কে প্রবেশ ও রাইডে চড়ার খরচ বাড়তে পারে, কারণ সেখানেও ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে। অনেকে আবার দেশে-বিদেশে ঘুরতে পছন্দ করেন। এজন্য ট্যুর অপারেটরদের সাহায্য নেন। এই সাহায্য নিতেও বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। কারণ ট্যুর অপারেটরদের ওপর নতুন ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া পরিবারের নিরাপত্তার জন্য বাসা-বাড়িতে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড রাখা হয়। এই সেবার ওপরও ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে সাধ্য অনুযায়ী এসি কেনার স্বপ্ন দেখছিলেন যারা, তাদের স্বপ্নে গুড়েবালি। কারণ এসি তৈরির মূল উপকরণ কম্প্রেসার ও অন্য উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন পর্যায়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে এসির দাম বাড়বে। একই অবস্থা ফ্রিজের ক্ষেত্রেও। ফ্রিজের কম্প্রেসার আমদানিতে শুল্ক এবং ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও খরচ বাড়বে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব, টিউব লাইটের। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কিন্তু আবার কর বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পরোক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ নতুন যে কর আসবে, তার দুই-তৃতীয়াংশ পরোক্ষ কর। তার মানে হলো আয় বাড়ানোর চাপ মানুষের ওপর পড়বে। একদিকে মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে আয়ের সম্প্রসারণ। এর চাপে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পড়বে। অবশ্য একেবারে নিরাশ করেননি অর্থমন্ত্রী। উপকরণ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়ায় মোবাইল ফোনের দাম কমতে পারে। ল্যাপটপ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হলেও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে ৩১ শতাংশের পরিবর্তে ২০ দশমিক ৫০ শুল্ক-কর দিতে হবে বিধায় ল্যাপটপের দাম কমতে পারে। কার্পেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল পলিপ্রোপাইলিন ইয়ার্ন আমদানির শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দেশে তৈরি কার্পেটের দাম কমতে পারে। ছোট-বড় সবার পছন্দের চকোলেট আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এ কারণে সব বয়সিদের পছন্দের চকোলেটের দাম কমতে পারে। তরুণ-যুবকদের পছন্দের বাহন মোটরসাইকেলের দাম কমতে পারে। কারণ সিকেডি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনের পার্টস আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। আয়কর খাতেও মধ্যবিত্তের জন্য সুখবর নেই। পক্ষান্তরে উচ্চবিত্তের জন্য করের চাপ বাড়ানো হয়েছে। এবার বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর সীমা বাড়ানো হয়নি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে আয় কমলেও বছর শেষে আগের নিয়মে আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা পেরুলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। আর অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে চার হাজার টাকা এবং অন্য জেলা, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের করদাতাদের জন্য তিন হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে। অবশ্য ধনীদের এবার অতিরিক্ত করারোপ করা হয়েছে। বর্তমানে ধনিক শ্রেণি ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেয়, বাজেটে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর আরোপ করা হয়েছে। বছরে আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেরুলে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। তবে নিত্যপণ্য যেমন ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর ডাল, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, ডাল, ভুট্টা, মোটা আটা, আটা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি, কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, ক্যাসিয়া পাতা, পাট, তুলা ও সুতা কেনার জন্য খোলা স্থানীয় ঋণপত্রের উৎসে কর ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও এসবের দাম কমতে পারে।