ঋণের বোঝা বাড়ছে। সরকার এবং জনগণের বড় অংশ চলছে ঋণের টাকায়। আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায় ১ লাখ ১৮ হাজার ২৭ টাকা ঋণের দায় চাপবে। কারণ বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু এই পরিমাণ ঋণ রয়েছে। এক বছরে যা বেড়েছে ১২ হাজার ৭৭৫ টাকা। আগামী এক বছরে তা কমপক্ষে ১৪ হাজার ৮১৭ টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৪ টাকা। এ কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও ঋণের সুদ পরিশোধে সর্বোচ্চ ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ ৪৬ হাজার ৯৩৭ টাকা। এ হিসাবে ঋণ মাথাপিছু বরাদ্দের প্রায় আড়াইগুণ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর দেশীয় উৎস থেকে সরকার যে হারে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক নয়। কারণ, সুদের হার বেড়েছে, যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ৯ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির তুলনায় করের অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ থাকা উচিত। তিনি বলেন, করের হার বাড়াতে পারলে ঋণ কমবে। আর উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আর্থিকখাতের শৃঙ্খলা নষ্ট নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২০ লাখ ৮ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯৩৬ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে ৪ লাখ ২৭ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। এ ঋণ জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশ। তবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমে আসছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ১ লাখ ১৮ হাজার ২৭ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ২৫২ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ১২ হাজার ৭৭৫ টাকা। এর মধ্যেই আগামী অর্থবছরে আরও ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এরমধ্যে বিদেশি ঋণ ৯০ হাজার কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ১ লাখ ৬০ হাজার ৯শ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। ফলে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি কমপক্ষে আরও ১৪ হাজার ৮১৭ টাকা বাড়বে। এই ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেওয়া হয়, তার বিপরীতে সরকারকে বছরে ১১ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এ কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার। যা তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় সমান। ঋণ না থাকলে এই টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যেত। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বাজেট বিশ্লেষণে বলা হয়, ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের বড় অংশই দেশীয় ঋণ। এর সুদ অত্যন্ত বেশি। এরফলে বেসরকারি খাতেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বাজেটে ঋণনির্ভরতা কমানোর জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে রাজস্ব খাতে সংস্কার জরুরি। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে ব্যাপক মুদ্রার (ব্রডমানি) পরিমাণ ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে আমানত ১৬ লাখ ৬২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং জনগণের হাতে নগদ টাকা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। আবার আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানত ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা এবং তলবি আমানত ১ লাখ ৯০ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা।