প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন বিশালাকৃতির জলাশয় ভরাট করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ওই জলাশয় হয়ে কসাইবাড়ী, বিমানবন্দর ও উত্তরা-২ ও ৪ নম্বর সেক্টরের একাংশে বৃষ্টির পানি এডি-৮ খাল হয়ে নিষ্কাশন হতো। জলাশয়টি ভরাট হওয়ায় ভারি বর্ষায় বিমানবন্দর সড়ক ও উত্তরার একাংশ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রকৌশলীরা। তাদের মতে, জলাশয়, ডোবা, নালাগুলো রাজধানীর বৃষ্টির পানির আধার। এসব ভরাট করে ফেললে বৃষ্টির পানি জমা হওয়ার কোনো জায়গা পাবে না। ইতোমধ্যে শহরের সিংহভাগ জলাশয় ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এখনো যেটুকু রয়েছে, সেগুলো পরিকল্পনা করে না রাখা গেলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন দুরূহ হয়ে পড়বে। সামান্য বৃষ্টিতে সড়ক, ফুটপাত, অলিগলি ডুবে যাবে। বর্তমানে যে অবস্থা রয়েছে, সবাই মিলে তা রক্ষার চেষ্টা না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। তারা জানান, প্রথমত, বিমানবন্দর স্টেশনসংলগ্ন জলাশয় ভরাট করা উচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, জলাশয় ভরাট করে রেলওয়ে যে বক্স কালভার্ট করছে, তা খুবই সরু। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসাবে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, রেলওয়ে তা শুনছে না। অথচ ভরাট করা জলাশয়ের ওপর স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে চাইলেও তা সংশোধন করার সুযোগ থাকবে না। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯ মে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালককে বক্স কালভার্ট প্রশস্ত করার বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে বক্স কালভার্ট প্রশস্ত করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়, উত্তরা সেক্টর-২, ৪, কসাইবাড়ী, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বিমানবন্দর অংশের পানি নিষ্কাশনের পথ বিমানবন্দর রেল স্টেশনের ১ ও ২ নম্বর প্ল্যাটফরমের নিচ দিয়ে বিদ্যমান নতুন বক্স কালভার্ট বা আগের জলাশয় হয়ে সিভিল এভিয়েশনের খাল ও এডি-৮ খালের সঙ্গে সংযুক্ত। নতুন করে ডিএনসিসি ৪ নম্বর সেক্টরের ১, ২, ২/এ, ২/বি, ২/সি, ২/ডি, ২/ডি, ২/ই, ২/এফ এবং ২ নম্বর সেক্টরের শায়েস্তা খান এভিনিউয়ের পার্শ্বস্থ রেললাইন সার্ভিস রোড হয়ে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন বক্স কালভার্ট পর্যন্ত ড্রেনেজ লাইন নির্মাণ, ফুটপাত নির্মাণ এবং সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ওই প্রকল্পের কাজ এখনো চলমান। ডিএনসিসির চিঠিতে আরও তুলে ধরা হয়, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন জলাশয় ভরাট করায় বৃষ্টি হলে বিমানবন্দর, উত্তরার সড়কের একাংশে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। ৮ মে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেন ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি। পরিদর্শন স্পটে রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক জানান, রেলওয়ের প্রয়োজনে সংস্থার খালি জায়গা বা জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। সেখানে স্টেশন প্ল্যাটফরম-৩ ও ৪ নির্মাণ করা হবে। তবে পানি নিষ্কাশনের জন্য ১ ও ২ অভ্যন্তরের বিদ্যমান বক্স কালভার্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১.৮ মিটার প্রশস্তে ৩ ও ৪ স্টেশন প্ল্যাটফরমের নিচের বক্স কালভার্ট তৈরি করা হবে। চিঠিতে রেলওয়ের ডিজিকে জানানো হয়, উত্তরা এলাকা, কসাইবাড়ী এলাকা, বিমানবন্দর সড়কসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা পানি নিষ্কাশন এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় রেলওয়ের নির্মাণাধীন বক্স কালভার্টের প্রশস্ততা ১.৮ মিটারের পরিবর্তে ন্যূনতম ৩ মিটার করা প্রয়োজন। এছাড়া বিমানবন্দর রেল স্টেশন প্ল্যাটফরম-৩ ও ৪, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং হাজি ক্যাম্প থেকে বিমানবন্দর এলাকার আন্ডারপাসের কারণে একটি উল্লেখযোগ্য ‘বহুমুখী কনস্ট্রাকশন হাব’ হওয়ায় ভবিষ্যৎ পানি নিষ্কাশন বিবেচনায় বক্স কালভার্টের প্রশস্ততা ৩ মিটার হওয়া আবশ্যক। জনস্বার্থে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে ডিএনসিসির চিঠিতে রেলওয়ের মহাপরিচালককে অনুরোধ জানানো হয়। তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২৭ মে ডিএনসিসির চিঠির জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগ। ফিরতি চিঠিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনের ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ (ডিটিজেডিএলপি) শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফরমে বক্স কালভার্ট নির্মাণের বিষয়ে ১৮ মার্চ ডিএনসিসিকে অবহিত করা হয়। পরে ৩১ মার্চে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলীর সভাপতিত্বে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিএনসিসির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সাপেক্ষে বক্স কালভার্টের কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় নকশা পরিবর্তন করা হলে বক্স কালভার্টের নির্মাণ ব্যয় ও সময় উভয়ই বেড়ে যাবে। রেলওয়ের পত্রে বলা হয়, নির্মাণাধীন বক্স কালভার্টটি ৮৭৭ কিউসেক পানি প্রবাহে সক্ষম। আর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমে এমআরটি-১-এর স্টেশন, উত্তরের সিভিল এভিয়েশনের বাউন্ডারি ওয়াল এবং দক্ষিণ পাশে আন্ডারপাসের এন্ট্রি-এক্সিট নির্মিত হবে। এজন্য মধ্যবর্তী স্বল্প ক্যাচমেন্ট এলাকা এবং ডিএনসিসির ড্রেনেজ পাইপের পানি প্রবাহের জন্য প্রস্তাবিত বক্স কালভার্ট যথেষ্ট। বিমানবন্দর বক্স কালভার্টের ওপেনিং ১.৮ মিটার এবং এর সঙ্গে ৩ মিটার ওপেনিং-এর কালভার্ট নির্মিত হলে সেখানে পানি প্রবাহের গতি কমে যাবে। সেখানে ক্রমাগত পলি জমা হবে। এর চেয়ে একই মাপের বক্স কালভার্ট নির্মাণ করে দুপাশে ওপেনিং পিট নির্মাণের বর্তমান সংস্থানই কারিগরি দিক দিয়ে যুক্তিযুক্ত। বিদ্যমান নকশা অনুযায়ী বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হলে তা পরিষ্কার করাও অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, শহরের অবশিষ্ট জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। তা না হলে এই শহরের ন্যূনতম বাসযোগ্য পরিবেশও থাকবে না। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি সংস্থা, এরপরও যদি তারা জলাশয়গুলো নির্বিচারে ভরাট করে, তাহলে কীভাবে এ শহর টিকবে? বর্ষা নামলে সড়ক, ফুটপাত ও অলিগলি ডুবে যাবে, রক্ষা করা যাবে না। সিটি করপোরেশন খাল, নর্দমা ও ডোবা রক্ষার চেষ্টা করছে। এ কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বেড়া যেন খেত না খায়, সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, বেড়ায় খেত খাওয়া বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সিটি করপোরেশন একা একা এ শহরকে জলজট, জলাবদ্ধতামুক্ত করতে পারবে না। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী নাজনীন আক্তার কেয়া বলেন, রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। এটা জনস্বার্থে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে পানি নিষ্কাশন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য বক্স কালভার্ট করে দেওয়া হচ্ছে। যদি এ বক্স কালভার্ট যথেষ্ট না হয়, তাহলে সিটি করপোরেশন বিকল্প পথ তৈরি করতে পারে। সে সুযোগ ওই এলাকায় রয়েছে। তিনি বলেন, যে নকশা অনুসরণ করে রেলওয়ে বক্স কালভার্ট তৈরি করছে, তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে ফিরে এলে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে প্রকল্প এবং বাস্তবায়নের সময়কালও বাড়বে।