আসছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ। বড় বড় প্রকল্পের সুদ ও আসল পরিশোধ শুরু হচ্ছে ২০২৬ সাল থেকে। পাশাপাশি একই বছর থেকে এলডিসি উত্তরণ ঘটিয়ে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে কমে যাবে স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণও। আছে ডলারের সংকট। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের জোগান বাড়িয়ে এ চাপ মোকাবিলার পথে হাঁটছে সরকার। তবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত কী পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে, এ বিষয়ে একটি প্রক্ষেপণ তৈরি করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা। তারা মনে করেন, এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যথেষ্ট সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। সেই সঙ্গে দেশের উন্নয়ন এক জায়গায় থেমে থাকবে না। যেসব উদ্যোগ আছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে শ্রীলংকার মতো ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু এ প্রস্তুতি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইআরডির সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আমাদের কোনো চাপ নেই। এখন যেসব ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে বা আগামী দিনে হবে, সেসব বিষয় আগে থেকেই আমাদের প্রক্ষেপণ করা আছে। সে অনুযায়ী পরিশোধ প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। তবে ডলারের জোগান বাড়ানোর নানা উদ্যোগ সরকারের আছে। আশা করছি, আমরা যেহেতু চিন্তাভাবনা করেই এগোচ্ছি, তাই কোনো সমস্যা হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধের বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এখনো এমন পর্যায়ে যায়নি যে কোনো সংস্থার কাছে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো, রেয়াতকাল বাড়ানো বা অন্য কোনো বিষয়ে প্রস্তাব দিতে হবে। সূত্র জানায়, বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ইতোমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬৭ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। আগামী সাত বছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছে ইআরডি। রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এমনকি মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। মূলত এসব কারণেই গত কয়েক বছরে ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে বেশকিছু মেগা প্রকল্পে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিস্তি পরিশোধ পুরোপুরি শুরু হবে ২০২৬ সালে। এছাড়া একই বছর ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। ২০২৭ সাল থেকে হবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ স্থাপন প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, মেট্রোরেল, পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিস্তি শোধ করা শুরু হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, ইআরডি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রপ্তানি বহুমুখীকরণের কাজ চলছে। ফলে এ খাত থকে ২০২৭ সালের মধ্যে সব মিলিয়ে ১১০ বিলিয়ন ডলার আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) ইতোমধ্যে ৬টি নতুন জাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যবসায় সরকারি প্রতিষ্ঠানটি ভালো করছে। বর্তমানে তাদের ৫টি জাহাজ আছে। নতুন জাহাজগুলো এলে ৩/৪ বছরের মধ্যে ডলার আয়ের সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান আছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এগুলোর বাস্তবায়ন হলে ঢেলে সাজানোর কাজ শেষ হবে। এর ফলে সেখানে বিদেশি জাহাজ আসা বাড়বে, কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে। ডলারের রোজগার বাড়বে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে এখান থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন হচ্ছে। বর্তমানে এ বিমানবন্দরের রানওয়রে দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার। সেটি বেড়ে যাবে। বর্তমানের ১ হাজার ৭০০ বর্গফুট থেকে সম্প্রসারণ করে ১০ হাজার ৭০০ বর্গফুট করা হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক বিমানবন্দর তৈরিতে অন্যান্য কার্যক্রমও চলছে। ফলে এটিতে বিমান চলাচল বেড়ে যাবে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি হবে আঞ্চলিক হাব। এখান থেকেও বৈদেশিক মুদ্রার আয় আসবে। চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে বে-টার্মিনাল। হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। এগুলোর কাজ শেষ হলে দক্ষিণ এশিয়ার চাহিদা মেটাতে বড় জাহাজগুলো এখানে আসবে। এ এলাকাটি হবে আঞ্চলিক হাব বন্দর। আরও আছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ। ২০৩০ সালের মধ্যে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৯৭টির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ১০টির কাজ শেষ হয়ে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন আছে ২৯টির বেশি। সরকারি, বেসরকারি, পিপিপি, জিটুজিসহ ৬ ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হচ্ছে। এসব বাস্তবায়িত হলে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে ৪০ বিলিয়ন ডলার যোগ করার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা)। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ আছে-এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়িয়েও ডলার আনার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। এমনকি মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে এসব প্রকল্প আলাদাভাবে মনিটরিংয়ের নির্দেশ দেন তিনি। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছেন মুখ্যসচিব। জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী রোববার বলেন, আগামী বছরগুলোয় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। ফলে ডলারের চাহিদাও বেড়ে যাবে। এছাড়া দেশের উন্নয়নের জন্য প্রবৃদ্ধি বড়াতে হবে। এজন্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন। আর উৎপাদন বাড়াতে হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে হবে। তখন ডলারের চাহিদা অনেক হবে। এজন্য ডলারের জোগান বাড়াতে হবে। তবে রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এখন রপ্তানির ৮০ ভাগের বেশি তৈরি পোশাক খাতনির্ভর। এক্ষেত্রে নীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। এছাড়া রেমিট্যান্সও খুব বেশি বাড়ছে না। পাশাপাশি অন্য যেসব প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং কাঙ্ক্ষিত ডলার আয় এখনো অনেক সময়ের ব্যাপার। আমাদের আকাক্সক্ষা আছে, কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। এজন্য কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সম্ভাব্য ডলার আহরণের খাতগুলো যাতে সত্যিকার অর্থেই কাজে আসে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু কথার কথা থাকলে হবে না। তাহলে আগামী দিনে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করাটা অন্যতম চ্যালেঞ্জে পরিণত হবে।