রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতিকদের দ্বারা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় জনপ্রশাসনের দ্বারা। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বদাই প্রশাসনিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক বা কৃত্রিম গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় বিপরীতভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসনিক ক্ষমতা। কারণ অগণতান্ত্রিক বা কৃত্রিম গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় জনসমর্থন না থাকায় বা কম থাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত অত্যন্ত দুর্বল হয়। এ কারণে সরকারকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতার দ্বারা জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সরকার জনপ্রশাসন দ্বারা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের এ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হয় জবাবদিহিবিহীন অসীম স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের। যেজন্য অগণতান্ত্রিক বা কৃত্রিম সরকারব্যবস্থায় সরকার আইনের অধীনে এ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অবাধ প্রয়োগের সুযোগ রাখে। এছাড়াও এ অগাধ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু জনপ্রশাসনের একটা বড় অংশ বিবেকবোধের তাড়নায় জনস্বার্থবিরোধীভাবে এরূপ স্বেচ্ছাধীন অগাধ ক্ষমতা প্রয়োগে আগ্রহী হয় না। এ কারণে জনপ্রশাসনের অনৈতিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিতে পারদর্শী কর্মচারীরা অগণতান্ত্রিক বা কৃত্রিম গণতান্ত্রিক সরকার বেছে নেয় এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অনৈতিক পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় অথবা পদায়ন করা হয়। জনপ্রশাসনের এ অংশটাই বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে এবং জনপ্রশাসনকে জনআস্থাহীন জনপ্রশাসন পরিণত করে। এখন প্রশ্ন হলো, স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (ডিসক্রেশনারি পাওয়ার) কী? সাধারণভাবে বলতে গেলে, নিজের বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করার স্বাধীনতাই স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। আইনগতভাবে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা হলো আইন দ্বারা পরিচালিত যুক্তিনির্ভর ও সুবিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা। এ ক্ষমতা অবশ্যই আইনানুযায়ী পরিচালিত হয়, কোনোক্রমেই ব্যক্তির মেজাজ-মর্জি দ্বারা পরিচালিত হয় না এবং তা কখনো স্বেচ্ছাচারিতামূলক, অনিশ্চয়তামূলক ও অনুমাননির্ভর হয় না। আইনে জনপ্রশাসনকে প্রয়োজনাতিরিক্ত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হলে সেই আইনটি আদর্শ আইন হিসাবে বিবেচিত হয় না। এছাড়া স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রয়োগ সম্পূর্ণ শর্তহীন হওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় এবং জনগণকে জনপ্রশাসন দ্বারা হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তও হতে হয়। যেমন ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যকে নিজস্ব বিবেচনায় কাউকে অপরাধী হিসাবে ধারণা করে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধারার অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতার আওতায় নিজস্ব মর্জিমাফিক বা সরকারের মর্জিমাফিক গ্রেফতারের জন্য কাউকে কখনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়েছে, এমন নজির বিরল। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ দেশে প্রচলিত অনেক আইন ও বিধিবিধানে জনপ্রশাসন কর্তৃক শর্তহীন স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রাখা হয়েছে; যার কারণে মধ্যযুগের অত্যাচারী রাজকর্মচারীদের ছায়া দেখা যাচ্ছে জনপ্রশাসনে, যা সুশাসনের জন্য সহায়ক নয়। প্লেটোর মতে, শাসকরা ‘আইনের ভৃত্য’। যেখানে আইন নিজেই শাসিত হয় এবং যার সার্বভৌম কর্তৃত্ব থাকে না, সেখানে ধ্বংসের পথই কেবল প্রশস্ত হয়। কিন্তু যেখানে শাসকদের ঊর্ধ্বে আইনের অবস্থান এবং শাসকরা আইনের ক্রীতদাস, সেখানে জননিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু অগণতান্ত্রিক বা কৃত্রিম গণতান্ত্রিক বা জনসমর্থন হারানো সরকার আইনের ভৃত্য নয়, তারা আইনের প্রভু। সরকার দ্বারা শাসিত হয় আইন। ফলে জনবান্ধব ভালো আইনেরও কোনো সুফল পায় না জনগণ। কিন্তু কেন এ অবস্থা? এর মূল কারণ ক্ষমতার রাজনীতি এবং এ ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের সব বিভাগ বা অঙ্গের একীভূত হওয়া। এরূপ একীভূত অবস্থায় স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের দ্বারা জনপ্রশাসন সরকারের ইচ্ছানুযায়ী আইন এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে। এ কারণে সরকার জনপ্রশাসনকে জবাবদিহির বাইরে রাখতে বাধ্য হয়। এতে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি লাগামহীন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন সমগ্র সরকারিব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা কখনো অসীম বা অগাধ নয়। এছাড়া এই স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা সর্বদাই বিবেচনাপ্রসূতভাবে প্রয়োগ করতে হয়। আইনের কোনো বিধানের কারণে জনস্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেজন্যই কেবল শর্তযুক্তভাবে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধানে রাখা হয়। কখনো জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রয়োগের সুযোগ রাখা হয় না। এছাড়া স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগকারী কর্মচারী কখনো জবাবদিহির বাইরে থাকেন না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক সময় বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধানে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার বিধান সংযোজনের ক্ষেত্রে এবং সেই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ নীতি অনুসরণ করা হয় না। সুশাসনের স্বার্থে বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধানে প্রদত্ত জনপ্রশাসনের অগাধ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইনসংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক