এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সংসার একরাম মিয়া ও দেলোয়ারা বেগমের। ভ্যানচালক একরামের অর্থাভাবের সঙ্গে ছিল না মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠাঁইটুকুও। থাকতেন পরিচিত কারও বাড়ির উঠোনে ঘর বেঁধে বা কারও ঘরের বারান্দায়। মাঝে মধ্যে ছেলে-মেয়েকে থাকতে হয়েছে খোলা আকাশের নিচেও। নিজের জমি বা নিজের ঘর তার কাছে যেন ছিল স্বপ্নের মতো। তবে তাদের সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হতে যাচ্ছে। ‘এ দেশে কেউ ভূমি-গৃহহীন থাকবে না’- বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার দরকাপাড়ায় জমিসহ পাকা ঘর পেতে যাচ্ছেন একরাম-দেলোয়ারা দম্পতি। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আপন ঠিকানায় এখন তারা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন। শুধু একরাম-দেলোয়ারাই নন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ৫ম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদুল আজহার আগে উপহার হিসাবে আজ মঙ্গলবার সারাদেশে আরও ১৮ হাজার ৫৬৬ ভূমি-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর হস্তান্তর করবেন। কক্সবাজারের ঈদগাঁও, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ এবং ভোলার চরফ্যাশনে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি জমি ও ঘর হস্তান্তর করবেন। এর মধ্য দিয়ে আরও ২৬টি জেলা এবং ৭০টি উপজেলা পুরোপুরি ভূমি-গৃহহীনমুক্ত হবে। এর আগে ছয় দফায় ৩২টি জেলার সব উপজেলাসহ ৩৯৪টি উপজেলাকে ভূমি-গৃহহীন মুক্ত করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এখন মোট ৫৮টি জেলা এবং ৪৬৪টি উপজেলা হবে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত। নতুন করে ভূমি-গৃহহীন মুক্ত জেলাগুলো হচ্ছে- ঢাকা, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে ঘর দেওয়ায় এখন পর্যন্ত ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ভূমি-গৃহহীন মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছেন ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু ঘর উপহার দিচ্ছেন না। তাদের জীবনমান উন্নয়নে দেওয়া হয়েছে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার এবং দেওয়া হয়েছে সেলাই মেশিনের কাজ। এছাড়া হাঁস-মুরগি, কবুতর পালন ও শাকসবজি উৎপাদনসহ কৃষি কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘিরেও রয়েছে নানা পরিকল্পনা। দরকাপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে একরাম মিয়া ও দেলোয়ারা বেগমও কথা হয়-তখন তারা জানালেন নিজের বাড়িতে উঠার পর কী কী করবেন। তা নিয়ে অনেক কিছু ভেবেও রেখেছেন। তারা বলেন, নিজের বাড়িতে এখন অনেক কিছু করতে পারবেন। অন্যের বাড়ির উঠোনে অথবা তাদের বারান্দায় ঘুমিয়েছি। টাকার অভাবে বড় ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। এখন মেয়েটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চাই। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক সুবিধাভোগী আসমা আক্তার। মাত্র তেইশ বছরের এই নারী স্বামী পরিত্যক্তা হয়েছেন কয়েক বছর আগে। বাবার বাড়িতে ঠাঁই নেওয়া এক কন্যা সন্তানের জননী আসমা আক্তার আগে কাজ করতেন চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টস কারখানায়। এখন তিনি আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন। এখন এখানেই থাকবেন। গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করার সুবাদে সেলাই মেশিন চালানো শিখেছেন। নিজেই একটি সেলাই মেশিন কিনে উপার্জনের পরিকল্পনা করছেন। আসমা বলেন, অল্প বয়সেই স্বামী আমাকে ছেড়ে গেছে। মেয়েকে মানুষ করতে চাই। সেজন্য উপার্জন দরকার। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, আজ কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও এবং মহেশখালী উপজেলার ২৬১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারে উপহারের পাকা বাড়ি হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৭৫, ঈদগাঁওয়ে ১৪৬ ও মহেশখালীতে ৪০টি ঘর রয়েছে। ইতোমধ্যে ২৬১টি ঘর নির্মাণ শেষ হয়েছে। এর আগে ঈদগাঁওয়ে ৩১৯, কক্সবাজার সদরে ৫১৯ ও মহেশখালীতে ৩৩১ পরিবারকে উপহারের ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। তিন উপজেলায় আরও ২৬১ পাকা বাড়ি হস্তান্তরের পর ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত উপজেলা হবে এই তিন উপজেলা। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কক্সবাজারের উখিয়ায় গৃহহীন ও ভূমিহীনরা জমি ও ঘর পেয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। তাদের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বেড়েছে। অনেকে তাদের ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিতে পারতেন না। কিন্তু তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়ায়, এখন আর ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে না। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে যারা ঘর ও জমি পেয়েছেন তাদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাউকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ আদা, হলুদ ও সবজি চাষ এবং কেউ গরু-ছাগল পালন করেও উপার্জন করছেন। তাদের কেউ সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আওতাভুক্ত হয়েছেন। তারা এখন প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমি-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ভূমি-গৃহহীন মানুষকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়ে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম হিসাবে সারাবিশ্বে প্রশংসিত দারিদ্র্যবিমোচনে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ‘শেখ হাসিনা মডেল।’