একুশের বইমেলার সূচনা করেছিলেন দেশের অন্যতম পেশাদার প্রকাশক মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা। প্রকাশক হিসাবে তার পেশাদারিত্বের সঙ্গে ছিল সৃজনশীল উদ্যোগ। Advertisement বইকে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার তার কৃতিত্বকে এখনো পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারেননি। বলাই বাহুল্য, দূরদর্শী চিত্তরঞ্জন সাহা বই যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন এক প্রকৃত এবং পূর্ণাঙ্গ প্রকাশক। মুক্তধারার বই বের হতো তাদের সম্পাদনা পরিষদের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে এবং প্রতি বছর তিনি লেখকদের বিক্রি হওয়া বইয়ের রয়্যালিটি হিসাব করে সম্মানের সঙ্গে সম্মানী পৌঁছে দিতেন। তার কথা মনে রাখেনি কেউ-তাকে আদর্শ বলে কেউ গ্রহণও করেননি। এমনকি তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটিও তার সেই সুনাম রক্ষা করতে পারেনি। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে এই দুঃসাহসী প্রকাশকের সূচনা করা একক বইমেলা এখন অনেক বিরাট হয়েছে। মাসব্যাপী উৎসবের আয়োজনে বই বিক্রি চলছে, কিন্তু বইয়ের জনক যে লেখক তিনিই পাচ্ছেন না তার প্রাপ্য ন্যূনতম পারিশ্রমিক। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, বলতে হয় বইমেলা একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। প্রকাশকরা কাগজের, কালির, বাইন্ডার, প্রেসের মূল্য দিচ্ছেন, কিন্তু লেখকই কেবল মূল্যহীন বেচারা তাদের কাছে! বিষয়টি হাস্যকর নয় কি? আমার নিজের অভিজ্ঞতা গত পঞ্চাশ বছরে অনেক বই বেরিয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে একমাত্র ‘প্রতীক’ প্রকাশনীর আলমগীর রহমান ছাড়া অন্য কোনো প্রকাশকই রয়্যালিটির অর্থ প্রদান করেন না। বই বিক্রির কোনো হিসাবও দেন না। লিখে যদি লেখক জীবিকা নির্বাহ না করতে পারেন, তাহলে কীভাবে সাহিত্যের উৎকর্ষ ঘটবে? কীভাবে সংস্কৃতি বাঁচবে? দেশের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের সংগঠন আছে। রিকশা শ্রমিক, বাস শ্রমিক, ট্রাক শ্রমিক, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন শিল্পী সংগঠন, শিক্ষক, সাংবাদিক, গার্মেন্ট শ্রমিক, আছে এমনকি প্রকাশকদেরও- শুধু লেখকদের কোনো পেশাদারি সংগঠন নেই-অথচ পাকিস্তান আমলেও ছিল লেখক সংঘ, যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মনীষীজন। বলা যায়, লেখকদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। তাদের বসার কোনো জায়গা নেই, মিলিত হবার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আর সেজন্যই দেখি, বইমেলা বিরাট হচ্ছে কিন্তু লেখক হারিয়ে যাচ্ছেন। এখন তো আবার শুনতে পাই-লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোনো কোনো প্রকাশক বই বের করেন। এসবই সুন্দরভাবে সূচিত বইমেলার বর্তমান নেতিবাচক দিক; বলা যায়, একদম বিপরীত বাস্তবতা; যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব কারণে আমি মনে করি, বইমেলার সম্পূর্ণ আয়োজন পেশাদার প্রকাশকদের হাতে সমর্পণ করা প্রয়োজন। বইমেলা আয়োজন করা বাংলা একাডেমির কাজ নয়। বইমেলা করতে গিয়ে বাংলা একাডেমি তার প্রকৃত কাজ থেকে বহু দূরে চলে গেছে। বই যেহেতু প্রকাশকদের উৎপাদিত পণ্য, সেটি বিপণনের দায়িত্বও তাদের। যেমন শিল্পমেলা করেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বইমেলায় বাংলা একাডেমির একটি স্টল থাকতে পারে প্রকাশনা হিসাবে, কিন্তু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তারা হতে পারে না। এটি বাংলা একাডেমির জন্য আত্মঘাতী। বাংলাদেশে ইট-পাথরের আকাশচুম্বী উন্নয়ন ঘটছে, কিন্তু নীতি, আদর্শ ও নৈতিকতার মৃত্যু ঘটছে; যা কিনা একটি জাতির জন্য ভয়াবহ। ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে চলছে স্বেচ্ছাচার। যার যেমন ইচ্ছা বাংলা ভাষাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া চালাচ্ছে-এটা শুরু করেছিল এফএম রেডিও’র জকিরা। এখন বিভিন্ন টেলিভিশন, অনলাইন প্লাটফরমে দূষিত বাংলার জগাখিচুড়ি চলছে। এ দুরবস্থা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও চলছে। একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদদের যে দাবি, যে আকাঙ্ক্ষা, আমরা সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। আমরা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছি। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই’ এসব মুখরোচক জনতুষ্টির স্লোগান ছিল না। এসব স্লোগান গভীর অর্থবোধক আদর্শের সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ কিংবা বলা যায় জীবনের মর্মানুভূতির মন্ত্রের মতো উচ্চারণ। এসব স্লোগানের নেপথ্যে নিহিত কর্তব্যবোধ, দায়িত্বশীলতা। মায়ের ভাষার জন্য জীবনদান করা কোনো ভাবালুতা নয়, হালকা ক্ষণস্থায়ী আবেগ-উচ্ছ্বাসের বিষয় নয়, জীবনের গভীর থেকে আসা, শেকড় বিস্তারী চেতনা। যতদিন আমরা সেই চেতনার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলাম ততদিন আমরা অর্জন করেছি-স্বাধীন দেশটাই সেই অর্জনের অনন্য উদাহরণ। স্বাধীন দেশে আমরা সেই অঙ্গীকারের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ শুরু করেছি। বাংলা ভাষার চর্চা, সব ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বেমালুম ভুলে শহিদ মিনারে ছবি টানানোর হানাহানির মধ্য দিয়ে অরাজকতার জন্ম দিয়েছি। আমরা শুধু শহিদবেদিতে ফুলই পদদলিত করিনি, আমরা পদদলিত করেছি নিজেদেরই। আমাদের যদি অর্জনের ধারায় ফিরতে হয়, তাহলে একুশের প্রকৃত অঙ্গীকারের কাছে ফিরতে হবে আর তা হচ্ছে মায়ের ভাষাকে মর্যাদা দিতে হবে জীবনের সর্বস্তরে।