দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ছিল পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে এটি আর থাকছে না। মুছে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর নাম। জুনেই প্রকল্পটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। নানা জটিলতায় প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত ব্যয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। তবে প্রকল্প শেষে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ কম হবে। এতে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বিশেজ্ঞরা মনে করেন-সেতুটি যখন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তখন সব জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। এমনকি ডলারের দামও কম ছিল। কিন্তু যতই দেরি হয়েছে ততই সব কিছুর বাজার মূল্য বেড়েছে। কাজেই সময় বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার মঙ্গলবার বলেন, পদ্মার মতো খরস্রোতা নদী বিশ্বে তেমনটা নেই। সেই নদীতে সেতু নির্মাণ করা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম সাফল্য। তবে রেলসংযোগ এবং নদী শাসনের জন্য অনেক সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত বেশি টাকা ব্যয় হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বেশি টাকা ব্যয় হয়েছে সেটি যৌক্তিক কারণে হয়েছে কিনা? যদি যৌক্তিক এবং প্রয়োজনের জন্য হয়ে থাকে তাহলে তো সমস্যা নেই। কিন্তু কম ব্যয়ের মধ্যেও যদি অযৌক্তিক খরচ করা হয় তাহলে সেটি তো কাম্য নয়। এছাড়া যে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়ে থাকে। পরে বাস্তবায়ন পর্যায়ে কম বা বেশি হতে পারে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করার সময় পরামর্শকরা কম খরচ দেখান। এর কারণ হলো কাজ শুরুর মাঝপথে যেহেতু প্রকল্প বন্ধ করা যায় না সেহেতু পরে খরচ বাড়লেও সমস্যা নেই বলে তারা মনে করেন। আবার শুরুতেই বেশি ব্যয় দেখালে তখন সরকার প্রকল্প নাও নিতে পারে। এজন্য তারা এমন চালাকি করে থাকেন। এটা একটা সমস্যা। তবে একথা বলা যায় যে, যদি সময় মতোই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতো তাহলে হয়তো ১০ হাজার কোটি থেকে খুব বেশি বাড়লে ১২-১৫ হাজার কোটির মধ্যেই শেষ হতো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সরে যাওয়া এবং নানা জটিলতায় দেরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এত বেশি টাকা লেগেছে। অর্থাৎ টাইম ওভার রান হলে অবশ্যই কস্ট ওভার রান হবেই। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যে কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগেই এর জটিলতা কি হতে পারে তা নিরূপণ করতে হবে। যাতে সময়মতো নির্ধারিত ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা যায়। তবে এ কথা সত্য যে, মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হলে এ ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হয়। যার বোঝা বহণ করতে হয় জনগণকেই। সূত্র জানায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। সে সময় মূল অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়াসহ নানা জটিলতায় শুরুতেই হোঁচট খায় প্রকল্পটি। পরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে নদীর তলদেশে মাটির স্তরের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে দ্বিতীয় সংশোধন করতে হয়। এ পর্যায়ে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মূল বরাদ্দের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ১৮ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে মেয়াদ আরও বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। ফের নতুন করে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ এবং ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার বলেন, এই জুনেই প্রকল্পটির সফল সমাপ্তি হচ্ছে। পদ্মা সেতু থেকে প্রতি মাসে সরকারের কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। এটা একটি মাইলফলক প্রকল্প। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা বলার সুযোগ নেই যে আগে বাস্তবায়ন হলে কি হতো আর এখন কি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত যা বরাদ্দ আছে সেখান থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ফেরত আসতে পারে বলে শুনেছি। তবে এখনও হিসাব চূড়ান্ত হয়নি। প্রকল্প শেষ হওয়ায় এটি আর আগামী অর্থবছরের এডিপিতে থাকছে না। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে (আরএডিপি) এ প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪০২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। কিন্তু চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি তৈরির সময় এটির মেয়াদ শেষের পথে থাকায় মাত্র ১ লাখ টাকা বরাদ্দের সঙ্গে তারকা চিহ্ন দিয়ে যুক্ত করা হয়। পরে সংশোধিত এডিপিতে এসে বড় অঙ্কের অর্থাৎ ২ হাজার ৬১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় পদ্মা সেতু প্রকল্প। এটি এ প্রকল্পের ইতিহাসের সর্বশেষ বরাদ্দ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রকল্প তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম।