সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব প্রতি ৫ বছর পর জমার বিধান শিথিল হচ্ছে। কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) দাখিল করা রিটার্ন থেকে প্রয়োজনে সরকার সংগ্রহ করবে এমন বিধানযুক্ত হচ্ছে। এতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সম্পদের বৃদ্ধি বা হ্রাসের হিসাব দাখিলের ক্ষেত্রে ছাড় পেতে যাচ্ছে। তবে সরকারি চাকরিজীবীদের বার্ষিক আয়কর রিাটার্ন দাখিলের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে। এছাড়া যারা আয় কর রিটার্ন দাখিল করবে না তারা বছর শেষে (ডিসেম্বর মাসে) নির্দিষ্ট ফরমে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করবে। সরকারি চাকরিজীবী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর খসড়া সংশোধনীতে এসব বিধিবিধানযুক্ত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মহিদুল ইসলাম বলেন, গণকর্মচারী আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯ সংশোধন করে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-২০২২ প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই গেজেট প্রকাশ করা হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে ৫ বছর অন্তর সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব দেওয়ার বিধান ছিল। এখন সরকার যখন চাইবে তখন দিতে বাধ্য হবে এমন বিধানযুক্ত করা হচ্ছে। কর্মচারীরা ৩ বছর অন্তর সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির হার উল্লেখ করে হিসাব দেবে এমন বিধান করার চিন্তাও চলছে বলে জানান তিনি। তাহলে কি ৫ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান বাতিল হচ্ছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে মহিদুল ইসলাম বলেন আরও কঠিন বিধান করা হচ্ছে। কি সেই বিধান এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন তো যখন-তখন সম্পদের হিসাব চাওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ৪৭ বছর পর ২০১৮ সালে দেশে প্রথম সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়ন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যা সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট ২০১৮ নামে অভিহিত। এই আইন পাশের আগে দেশের সিভিল প্রশাসন সময়ে জারি করা অধ্যাদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ, পরিপত্র, বিধিমালা, নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়ে আসছে। নতুন সরকারি কর্মচারী আইনে বলা হয়েছে, ইতঃপূর্বে জারি করা বিধিমালা, নীতিমালাগুলো এই আইনের বিধানের আলোকে যুগোপযোগী করতে হবে। এর অংশ হিসাবে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-২০২২ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি হিসাবে একজন সরকারি কর্মচারীকে সংজ্ঞায়িত করে। বিদ্যমান বিধিমালার ১৩ ধারা অনুযায়ী, বেসামরিক কর্মচারীরা চাকরিতে যোগদানের সময় তাদের এবং পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, শেয়ার, সার্টিফিকেট, বিমা পলিসি এবং অলঙ্কার ঘোষণা করতে বাধ্য। সরকারি কর্মচারীরা চাকরিতে যোগদানের সময় একটি ঘোষণা দেন। এরপর তাদের সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণ জমা দেন না। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, প্রস্তাবিত পরিবর্তন সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ মো. ইউসুফ হারুন বলেন, আমি জনপ্রশাসন সচিব থাকা অবস্থায় সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। না হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউসুফ হারুন বলেন, আচরণ বিধিমালায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব, আয়-ব্যয় সংক্রান্ত বিধিবিধান রয়েছে। যতদিন আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা না হবে, ততদিন তারা খানিকটা নিরাপদে থাকবে। তিনি আরও বলেন, নতুন আচরণ বিধিমালা হোক বা না হোক ১৯৮৯ সালের গণকর্মচারী আচরণ বিধিমালার আলোকে প্রত্যেক কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, আগে প্রতিবছর কর্মচারীদের সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব দিতে হতো। পরে সময় বাড়িয়ে তা ৫ বছর অন্তর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির হার উল্লেখ করে জমা দেওয়ার বিধান করা হয়। কিন্তু আমি শুনেছি সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা থেকে ৫ বছর অন্তর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান শিথিল করা হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের জন্য চরম আত্মঘাতীমূলক কাজ হবে। তিনি বলেন, যদি নতুন প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এটি সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করে দেবে এবং দুর্নীতি উৎসাহিত করতে পারে। প্রস্তাবগুলো অনুমোদন হলে সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত হবে এ ধরনের বিধিমালা প্রণয়ন না করা। ১৯৭৯ সালের গণকর্মচারী আচরণ বিধিমালাই যথেষ্ট। গণকর্মচারী আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯ অনুসারে সর্বস্তরের কর্মচারী প্রতি ৫ বছর অন্তর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করে হিসাব জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরকারি কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন। এরপর ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাবে জমা দেওয়া কথা থাকলেও তা নেওয়া হয়নি।