সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে আলোচিত প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়ার ইস্যুতে বিব্রত সরকার ও আওয়ামী লীগ। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাদের মধ্যে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের প্রশ্নে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য জনমনে আরও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বেশির ভাগ নেতা সরকারের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা তুলে ধরে বক্তব্য দিলেও কেউ কেউ এমন সব বক্তব্য দিচ্ছেন, যেটা দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিয়ে ‘সাফাই গাওয়া’র শামিল হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ও দলকে আরও অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে, এমনও মনে করছেন অনেকে। সম্প্রতি সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয় নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। একই সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে ছাগলকাণ্ডে জড়িয়ে এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানানোর অবিশ্বাস্য তথ্যও প্রকাশ্যে আসায় হতবাক সবাই। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মাটিতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পেছনেও দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের মতো কারণ উঠে এসেছে। এসব বিষয় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক পুলিশ ও প্রশাসনিক দুর্নীতি-লুটপাটের ভয়ংকর চিত্র গণমাধ্যমে উঠে আসছে। এতে সরকার ও আওয়ামী লীগের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত বহুল আলোচিত সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের ‘দায় এড়াতে’ নীতিনির্ধারক নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সরকার ও দলের মধ্যকার ‘নার্ভাসনেস’কেই ফুটিয়ে তুলছে। কাজেই কথার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকার ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এদিকে বেনজীর-আজিজ-আজীম ইস্যুতে শুরু থেকেই সোচ্চার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুরুর দিকে দলীয় ফোরামের একাধিক সভায় সরকারের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি পুনর্ব্যক্ত করে ‘বেনজীর-আজিজ আওয়ামী লীগের লোক নন’ এবং তাদের বিচার চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর কয়েক দিন পর অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া বিবৃতি বিভিন্ন মহলের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কিছু বক্তব্য দুর্নীতিবাজদের পক্ষেই ‘সাফাই গাওয়া’ কিনা– এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। গত ২১ জুন দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রায় ‘ঢালাওভাবে পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা আজকে গুজব ছড়াচ্ছেন। পুলিশকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করছেন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের মতলব আছে। ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বানানোর যে চক্রান্ত চলছে, এটা আওয়ামী লীগকে হটানোর জন্য ষড়যন্ত্র কিনা, সেটা ভেবে দেখতে হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ইদানীং যেসব ঘটনা ঘটছে, আমি বিশ্বাস করি– এগুলো ষড়যন্ত্রেরও অংশ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ আজ কিছু দুর্নীতিবাজ ও সাবেক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। অবশ্য ব্যাংক লুটেরা, অর্থ পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করে তিনি বলেন, কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে– যাদের বিরুদ্ধে আজ অভিযোগ, তারা কেন আইনকে ভয় পেয়ে বিদেশে চলে যায়? আইনকে ভয় পায় বলেই তো আমাদের ভয় হয়– নিশ্চয়ই তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। কেউ কেউ মনে করেন, এ রকম একটা ইস্যুর সঙ্গে বিরোধী দলের সরকার পতন আন্দোলনের যোগসূত্র খুঁজতে যাওয়ার বিষয়টি আসলে দুর্নীতিবাজদের পক্ষেই যায়। আবার গড়পড়তা বিষয়টিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়াও প্রকৃতপক্ষে অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনে আরও উৎসাহিতই করবে। যদিও গত দু’দিনে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের অন্য দুই জ্যেষ্ঠ নেতার সাহসী বক্তব্য বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ এবং আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম একের পর এক সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি, বাড়ি, জমিসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য সামনে আসার প্রেক্ষাপটে রীতিমতো ক্ষোভ ঝাড়েন। রাজনীতিবিদদের পাশ কাটিয়ে আমলাদের ওপর সরকারের অতি নির্ভরতা এবং আইন করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার বিধান শিথিল করায় উষ্মা প্রকাশ করে তা সংশোধনের দাবিও তোলেন আওয়ামী লীগের এই নেতারা। গত মঙ্গলবার সংসদে হানিফ বলেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির পরও দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আজ বাজারে অস্থিতিশীতা দেখা যায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়। বাজার কখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, যদি বাজারে দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ থাকে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি হয় তো সরকারের উন্নয়ন ও কেনাকাটায়। সেখানে একজন রাজনীতিবিদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত না থাকেন? এর এক দিন পর বুধবার সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কোরবানির ঈদ ঘিরে কোটি টাকার গরু ও ১৫ লাখ টাকার ‘ছাগলকাণ্ড’ তুলে ধরে বলেন, যারা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকেন, যেমন মতিউরকে দুর্নীতি দমন কমিশন ও গণমাধ্যম এমনকি রাজনীতিবিদরাও চিহ্নিত করতে পারেননি। তাঁকে একটি বোবা প্রাণী ছাগল চিহ্নিত করেছে। এমন মতিউর আরও আছে কিনা, ভবিষ্যতে ছাগল বা অন্য কোনো বোবা প্রাণী চিহ্নিত করার আগেই তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংস্থার। সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরও কেন দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে– এমন প্রশ্নও তোলেন আওয়ামী লীগের এ নেতা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই কাছে প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক নেতা বলেছেন, বেনজীর-আজিজ-আজীম ও আছাদুজ্জামানকাণ্ড এবং সর্বশেষ ‘ছাগলকাণ্ডের’ মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতি-লুটপাট প্রকাশ্যে আসার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে সরকারের দুর্বল অবস্থানকেই তুলে ধরেছে। প্রশ্ন উঠছে, টানা চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন একটি সরকার এবং তার এত সংস্থার অজ্ঞাতসারে এত বড় বড় দুর্নীতি-লুটপাটের ঘটনা কীভাবে চলতে পারে? গণমাধ্যম বা অন্য মাধ্যমে খবর প্রকাশের আগেই সরকার কেন এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে? আবার মুখে অনেক কথা বললেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের আদৌ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আছে কিনা– এসব ইস্যু সেই প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় জনমনে সৃষ্ট ক্ষোভ এবং নিজস্ব ভাবমূর্তি ফেরাতে এখনই সরকারকে বিষয়টি কঠোর হাতে দমনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো আসছে, তারা বাস্তবে সরকারের প্রশাসনিক বা নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, যোগসাজশও জড়িত, যার কারণে দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহি বা শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে এদের দুর্নীতির দায় থেকে মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে জিরো টলারেন্সের কথা বলা রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও রয়েছে। কিন্তু শুধু অঙ্গীকার থাকলেই হবে না, সেটাকে বাস্তবায়নের পদক্ষেপও থাকতে হবে। সেটা নেই বলেই দুর্নীতি বা দুর্নীতিবাজ দমনের ক্ষেত্রে আমাদের সন্দিহান করে তোলে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করে চলেছে। যারা দুর্নীতি করে, তাদের শাস্তি তো দেওয়াই হয় না, বরং নানাভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করে সরকারের উদ্দেশ্যকেই চরিতার্থ করছে। আর একজন দুর্নীতিবাজের শাস্তি যখন হয় না, তখন অন্যরাও উৎসাহ পায়। আসলে এভাবে দেশটাকেই দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছে।