রাজধানীতে ছিনতাই রোধে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ছিনতাইবিরোধী টাস্কফোর্স। এর অংশ হিসাবে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের নাম, মোবাইল নম্বর এবং ছবি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের নজরদারির আওতায় আনার। কারণ, চাকরিচ্যুত কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের নেতৃত্বে ছিনতাই হচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। শুধু তাই নয়, পুলিশের সব টহল গাড়িতে লাগানো হবে ট্র্যাকার। এর মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে গাড়ি। এছাড়া ছিনতাইয়ের হটস্পটগুলোতে ছদ্মবেশে বসে থেকে হাতেনাতে ছিনতাইকারীদের ধরার কৌশল নেওয়া হয়েছে টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা সবসময়ই ছিল। গত বছরের মে থেকে তারা হয়ে উঠে বেপরোয়া। তাদের হাতে প্রাণহানি ঘটে সাধারণ মানুষের। এমনকি পুলিশ সদস্যরাও রেহাই পাননি ছিনতাইকারীদের কবল থেকে। ওই বছরের ১ জুলাই ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের কনস্টেবল মনিরুজ্জামান নিহত হন। এরপর ওই মাসেই শুরু হয় পুলিশের বিশেষ অভিযান। ১৫ দিনে ডিএমপির ৫০ থানায় বিশেষ অভিযানে ৮ শতাধিক ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়। তাদের অনেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার নেমে পড়ে ছিনতাইয়ে। এমন বাস্তবতায় গত বছরের ৯ অক্টোবর ছিনতাইবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। গ্রেফতার করা হয় অনেক ছিনতাইকারীকে। এর পরও বন্ধ হয়নি তাদের তৎপরতা। ডিএমপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, টাস্কফোর্স গঠনের আগের পাঁচ মাসে ডিএমপিতে ছিনতাইয়ের মামলা হয় ৯২টি। আর টাস্কফোর্স গঠনের পর গত আট মাসে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১৮৭টি। ছিনতাইকারীদের তৎপরতা রোধে টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে-জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা রাজধানীতে ছিনতাইয়ের হটস্পট চিহ্নিত করেছি। সে অনুযায়ী অভিযান শুরু হয়েছে। রাজধানীর ব্যাংকপাড়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাসস্ট্যান্ড, স্টপেজ, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, লেক, বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, গার্ডেন, উদ্যান, পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবন্দর, গুলিস্তান, সদরঘাট, বেড়িবাঁধ, ৩০০ ফুট, দিয়াবাড়ী, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসসহ বিভিন্ন স্পট থেকে গত কয়েক দিনে বেশকিছু ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভেতর ও বাইরের রাস্তা কভার করে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গতিবিধি নজরদারিতে আনা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাইভেটকারে বসে ছিনতাইকারীরা ওঁৎ পেতে থাকছে। তাই ওইসব গাড়ির বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। আগে গ্রেফতার করা ছিনতাইকারীদের বসবাসের স্থান চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। থানার রাত্রীকালীন সব পেট্রল গাড়ির মুভমেন্ট নিশ্চিত করা হয়েছে। ডিএমপির অপরাধ বিভাগের একজন উপকমিশনার জানান, ছিনতাই প্রতিরোধে থানায় থানায় পৃথক টিম গঠন করা হয়েছে। চৌকশ কর্মকর্তাদের দিয়ে মোটারসাইকেল টহল মোতায়েন করা হয়েছে। রাজধানীর যেসব জায়গায় আলোর স্পল্পতা রয়েছে সেসব জায়গায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা, মামলার রহস্য উদ্ঘাটন ও আসামি গ্রেফতারে থানা পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিভিন্ন পাইকারি আড়তের সভাপতি সাধারণ সম্পদকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তি ও সন্দেহভাজনদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেসব প্রাইভেটকার, সিএনজি ও মাইক্রোবাসে ছিনতাই হয় সেসব যানবাহনের মালিকানা যাচাই করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম আপডেটের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা নিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফুট ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা অযাচিত ব্যক্তিদের তল্লাশির পাশাপাশি সব ধরনের ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করা হবে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজনদের আটক করা হবে। নজরদারিতে রাখা হবে জামিনপ্রাপ্ত ছিনতাইকারীদের। এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, রাজধানীর ছিনতাই রোধে আমরা সবসময়ই তৎপর থাকি। তার পরও ছিনতাইকারীরা অপতৎপরতা চালায়। তাদের অপতৎপরতা বন্ধের জন্যই আমরা ছিনতাইবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছি। টাস্কফোর্স গঠনের পর ছিনতাই ছিনতাইকারীদের তৎপরতা অনেকাংশে কমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বড় কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, বড় কোনো উৎসবকে ঘিরে ছিনতাইকারীরা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। টাস্কফোর্সের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে গত দুটি ঈদে খুব একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। ডিএমপির উপকমিশনার (ক্রাইম) মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, ডিএমপিতে বর্তমান কমিশনার যোগদানের পর প্রথম ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরকে ছিনতাইমুক্ত করা আমার অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’ এ বিষয়টি মাথায় রেখে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তিনি বলেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে ঢাকায় বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রামপুরায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রযোজনা সহকারী রাকিবুল হাসানের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আদনান সাঈদ এবং ফার্মগেটে পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামান খুন। এসব ঘটনার পর পুলিশ বিশেষ অভিযান চালায়। এর পরও প্রতিনিয়ত পথচারীদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছিল ছিনতাইকারী চক্র। মাঝেমধ্যে প্রাণও যাচ্ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে ছিনতাইবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ইতোমধ্যেই নগরবাসী এই টাস্কফোর্সের সুফল পেতে শুরু করেছে।