উন্নত গুণমান ছাড়াও আরও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশি জাতের গরুর কদর রয়েছে বিভিন্ন দেশে। অটুট স্বাস্থ্য, খাবারের কম চাহিদা, প্রচণ্ড গরমের আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন দেশে ‘দেশি’ গরুর উৎপাদন-চাহিদাও বেশি। দেশি গরু স্বাদেও এগিয়ে। তার পরও বিশেষ করে বাংলাদেশে ব্রাহমা জাতের গরু নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। কিছু মানুষের কাছে এর চাহিদা আকাশচুম্বী। তবে বাংলাদেশে এর বেচাকেনা ‘নিষিদ্ধ’। প্রাণিসম্পদ অধিপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সাফ বললেন, ‘নিষিদ্ধ নয়, এ গরু এ দেশে আনা নিষিদ্ধ- এমন কিছু লেখা নেই। তবে ব্রাহমা জাতের গরু আনতে হলে আইন-বিধি মেনে আবেদন করতে হবে। আবেদন গ্রহণ নাও হতে পারে। আমরা দেশীয় জাতকে প্রাধান্য দিচ্ছি। দেশীয় জাত, হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান এগিয়ে নিতে চাই। আমরা যে সিমেন দিচ্ছি, সেখানে ব্রাহমা প্রজাতির গরু উৎপাদনে কিছু নেই। অর্থাৎ ব্রাহমা উৎপাদনে সিমেনও আমরা দিচ্ছি না।’ এ জাতের গরু বাংলাদেশে পালন ও উৎপাদন নিষিদ্ধ না হলেও ২০১৬ সালের এক নীতিমালার মাধ্যমে এ জাত আমদানি নিষিদ্ধের তালিকায় রাখা হয়েছে। সম্প্রতি ব্রাহমা প্রজাতির গরু, বাছুর এবং সিমেনের সন্ধান মিলেছে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে। দুদক এসব জব্দও করেছে। এর আগে ২০২১ সালে ঢাকার বিমানবন্দরে অন্তত ৩০টি ব্রাহমা গরু জব্দ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা তখন জানিয়েছিলেন, আমদানি নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরুগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে আনা হচ্ছিল। তবে যারা ব্রাহমা আমদানির পক্ষে তাদের ভাষ্য, ব্রাহমা উন্নত জাতের মাংসল গরু। এটি যুক্তরাষ্ট্রের গরু হলেও এর আদিনিবাস ভারত উপমহাদেশে। ফলে বাংলাদেশে অন্যান্য গরুর মতো এরও আমদানি-উৎপাদন জরুরি। বাংলাদেশের পশু কুরবানির বড় অংশ একসময় আসত ভারত থেকে। বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত দেশীয় গরু রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে কুরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা গরুর অন্তত ২০ থেকে ৩০ লাখ অতিরিক্ত হিসাবে থেকে যায়। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু বন্ধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে। এক পর্যায়ে দেশে মাংসের চাহিদা পূরণ নিয়ে সংশয় তৈরি হলে ব্রাহমা গরু উৎপাদনের দিকে যাওয়া হয়। উৎপাদন শুরুও হয়। তবে এ জাত নিয়ে নানাভাবে শুরু হয় প্রতারণা। ফ্রিজিয়ানসহ নানা জাতকে চালিয়ে দেওয়া হয় ব্রাহমা হিসাবে। অপরদিকে দেশীয় গরু উৎপাদনে থাকা হাজার হাজার কৃষক-খামারি ব্রাহমার বিরোধিতা করতে শুরু করেন। ব্রাহমাকে ঘিরে তৈরি হয় একটি বিশেষ চক্র। এ চক্র নিয়ন্ত্রণে আছেন গুটি কয়েক ব্যক্তি-খামারি। সবশেষে ২০১৬ সালে সরকারের কৃত্রিম প্রজনন নীতিমালার অধীনে বেসরকারিভাবে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে খামারিদের মাধ্যমে ব্রাহমা গরু আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার সিমেন দিচ্ছে, সেই সিমেন কিন্তু ব্রাহমা গরু উৎপাদনের সিমেন নয়। কিন্তু, কিছু অসাধু ব্যক্তি-খামারি ব্রাহমা জাতের গরুর সিমেন নিতে আসছে। শুধু মাংস দিয়ে গরুকে নির্ণয় করা ঠিক নয়। ব্রাহমা জাতের গাভী যত বড়-সেই তুলনায় দুধ কম দেয়। এ গরুর বাছুরের আকার বড় হওয়ায় দুধের চাহিদা বেশি হয়ে থাকে। দেশে যদি, খামারিরা ব্যাপক হারে ব্রাহমা উৎপাদন করেন, তাহলে গরুর দুধের উৎপাদন তলানিতে ঠেকবে। দেশের অধিকাংশ কৃষক-খামারিও চাচ্ছেন না ব্রাহমার প্রসার ঘটুক। মূলত সেজন্যই বেসরকারি পর্যায়ে ব্রাহমা গরু আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাপক হারে ব্রাহমা গরু উৎপাদন হলে হোলস্টেইন জাতের বা ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে কৃষক-খামারিরা। এই জাতের গরু দুধ উৎপাদনের জন্য বিশ্বসেরা। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (দুগ্ধবিজ্ঞান) ড. একেএম হুমায়ুন কবির বলছেন, ‘ব্রাহমা আমাদের এই উপমহাদেশেরই গরুর একটি জাত, মাংসের গুণ ও উৎপাদনের দিক দিয়ে এ জাতের গরু অনেক ভালো। জাতটি এ অঞ্চলের আবহাওয়া উপযোগী ও রোগপ্রতিরোধী। তাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা সাপেক্ষে এ জাতের গরু লালন পালন করে দেশের মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মাংস রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’ রাজধানীর পুরান ঢাকাস্থ নবাবপুরে দুধ বিক্রির হাটের পাইকারি বিক্রেতা হরিপদ ঘোষ বলেন, ‘দেশি এবং ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর বিকল্প নেই। এদের দুধ বাজার দখল করে আছে। এসব গরু নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। ব্রাহমা নিয়ে যে কেলেংকারি তা সাধারণ কৃষক-খামারিদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।’