র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সদস্য রেজাউল হক কিরনের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে নতুন করে বিতর্কে জড়িয়েছেন সাবেক এমপি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন। বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আলোচিত এ নেত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন দলের নেতারাও। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ, পদবাণিজ্য, কেন্দ্র থেকে আসা টাকা আত্মসাৎসহ নিজস্ব লোকজনকে পদ-পদবি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। যদিও এসব স্বীকার করেননি তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মিথ্যা ছড়াচ্ছে বলে দাবি তার। বরিশাল জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক কিরনকে ৩ জুলাই গ্রেফতার করে র্যাব। তিনি মাদক বাণিজ্যের অভিযোগে এর আগেও কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছেন। তার গ্রেফতার প্রসঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেয়নি তার দল। জেলা যুবদল সভাপতি তসলিম উদ্দিন বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর তাই তদন্ত না করে মন্তব্য করব না। সংগঠন যখন কিরনের ব্যাপারে নীরব ঠিক সেই মুহূর্তে গণমাধ্যমে তার পক্ষে কথা বলেন শিরিন। নির্দোষ দাবি করার পাশাপাশি কিরন ষড়যন্ত্রের শিকার-বলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরিচয় না প্রকাশের শর্তে মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, কেবল কিরন নয়, শিরিনের সহচর বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মুশফিকুল হাসান মাসুমও মাদক ব্যবসায়ী। কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছেন তিনি। এ দুজনই দলে পদ পেয়েছেন শিরিনের জোনের। যোগ্যতা না থাকলেও ঘনিষ্ঠ হিসাবে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ পাইয়ে দিয়েছেন শিরিন। স্থানীয় নেতারা এভাবে বললেও তা মানতে নারাজ তিনি। কিরন-মাসুমকে রাজপথের কর্মী দাবি করে শিরিন বলেন, কে কী বলল তাতে কিছু আসে যায় না। ওরা রাজপথের কর্মী। দমনপীড়নের অংশ হিসাবে গ্রেফতার হয়েছে। পরীক্ষিত নেতা হিসাবে তাদের পক্ষে বলেছি। ত্যাগী-পরীক্ষিত দাবি করে উল্লেখিত দুজনের পক্ষে বললেও খোদ শিরিনের বিরুদ্ধেই রয়েছে আন্দোলনে না থাকার অভিযোগ। ১৫-১৬ বছরে তেমন কোনো মামলা হয়নি তার বিরুদ্ধে। দীর্ঘ এসময়ে মাত্র একবার গ্রেফতার হলেও আদর যত্নে থেকে মাত্র তিন দিনেই জামিন পান। আরও কিছু কারণে আওয়ামী কানেকশনের অভিযোগ উঠেছে সাবেক এ এমপির বিরুদ্ধে। বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে গত বছরের ১ নভেম্বর গ্রেফতার হই আমি ও শিরিন। মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক এমপি হিসাবে ডিভিশন পাওয়ার কথা থাকলেও জেলখানায় তা পাইনি। অসুস্থ হিসেবে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য করা আবেদনও প্রত্যাখ্যাত হয়। অথচ গ্রেফতারের দিনই শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে চলে যান শিরিন। ৩ দিনের মাথায় নিম্ন আদালত থেকে জামিন পান। আমাদের প্রায় ২৫ দিন থাকতে হয় জেলে। জামিন পাই হাইকোর্ট থেকে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সিটি নির্বাচনে বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ওঠে শিরিন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। নগরের ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডে মেয়র খোকনের শ্বশুরবাড়ির পাশেই শিরিনের বাসা। এমনকি সংবাদ সম্মেলন করে শিরিনের বিরুদ্ধে নৌকার পক্ষে কাজ করার অভিযোগ পর্যন্ত করেন পরাজিত মেয়র প্রার্থী বিএনপি নেতা সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপম। গত বছরের নভেম্বরে গ্রেফতার ও তিন দিনের মাথায় ছাড়া পাওয়ার পর বরিশালের কোনো আন্দোলনে আর দেখা যায়নি শিরিনকে। সবার ধারণা, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা না রাখার শর্তেই জামিন পান এ নেত্রী। অভিযোগ সম্পর্কে শিরিন বলেন, দলের ভেতর যারা গোলমাল বাধাতে চান তারা এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করছি। দলের জন্য জীবন বাজি রেখেছি। কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন আমার সম্পর্কে। উড়ে এসে জুড়ে বসারা এসব কথা বলছেন। আপনার বিরুদ্ধে কতগুলো মামলা আছে, কতবার জেলে গেছেন জিজ্ঞেস করতেই ক্ষেপে যান এ নেত্রী। বলেন, মামলা আছে কী নেই, কতবার জেলে গেছি সেটা দেখবে আমার দল। আপনার কাছে জবাবদিহিতা কেন করব! আন্দোলনের তহবিল তছরুপ ও কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে শিরিনের বিরুদ্ধে। সবশেষ সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনায় বরিশাল বিভাগের জন্য একটি মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। পরিচয় না প্রকাশের শর্তে কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, পুরো টাকা দেয়া হয় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা শিরিনকে। প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো ছিল ওই বরাদ্দে। টাকা পেলেও তা বিতরণ প্রশ্নে নানা অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। কেন্দ্র থেকে পাঠানো টাকা কেউ পেয়েছেন তেমন নমুনাও মেলেনি। মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবীর বলেন, আমাদের টাকায় আন্দোলন চালিয়েছি। কেন্দ্রের কোনো টাকা পাইনি। জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহবায়ক সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান বলেন, আন্দোলন চালিয়েছি ব্যক্তিগত আর নেতাকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া টাকায়। কেন্দ্রের কোনো সহায়তা পাইনি। প্রায় একই কথা বলেন বরিশালের বিভিন্ন জেলার আরও অনেক নেতা। জেলা উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত কমিটি গঠন প্রশ্নে শিরিনের অনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পছন্দের লোককে নেতা বানানোর অভিযোগও করেছেন অনেকে। বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, কমিটি প্রশ্নে অনুগতদের পদ দেওয়ার চেষ্টা চালান শিরিন। তিনি যোগ্য নাকি অযোগ্য সেটা বিবেচ্য ছিল না। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে পটুয়াখালীর কমিটি করার দায়িত্ব ছিল শিরিনের। কেন তাকে সেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো-এটা খুঁজলেই তো বাকি সব পরিষ্কার। দল নয়, নিজের আখের গোছানোর টার্গেট নিয়ে পটুয়াখালী আসতেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ওঠায় সরিয়ে দেওয়া হয়। কমিটি গঠন নিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় তার বিরুদ্ধে মিছিল এবং ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। এসব বিষয়ে শিরিন বলেন, আন্দোলনের জন্য আবার বরাদ্দ কী? আমাকে দায়িত্ব দেয় কেন্দ্র, কোনো জবাবদিহিতা থাকলে তা কেন্দ্রের কাছে। আপনারা কে? কমিটি নিয়ে বাণিজ্য বিষয়ে বলেন, ফালতু অভিযোগ। যেসব জেলার কথা বলা হচ্ছে তার কোথাও এখনো কমিটি হয়নি। তাহলে বাণিজ্য কিংবা নিজের লোক বসালাম কী করে? রাজনৈতিক শত্রুরা এসব মিথ্যা রটাচ্ছে।